টানা অবরোধে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসায় ধস

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ২০১৫ সালের পর এমন সংকটে আর পড়েননি তারা। এমনকি কোভিড মহামারির ভেতরেও এরকম মন্দা তৈরি হয়নি।
sundarban
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুন্দরবনে পর্যটক সংখ্যা কমেছে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

কুয়াশার চাদর জড়িয়ে শীত নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। ঘরে ঘরে শিশু শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ভ্রমণের প্রকৃষ্ট সময় তো এখনই। কিন্তু সে ইচ্ছায় বাধ সাধছে দেশের বিদ্যামান রাজনৈতিক অস্থিরতা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা টানা অবরোধ-হরতালের কারণে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবসা। বড় ধরনের ধসের মুখে পড়েছেন এখানকার ট্যুর অপারেটররা।

এই ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একের পর এক বুকিং বাতিল করছেন পর্যটকরা। নতুন কেউ আসছেনও না। ২০১৫ সালের পর এমন সংকটে আর পড়েননি তারা। এমনকি কোভিড মহামারির ভেতরেও এরকম মন্দা তৈরি হয়নি।

খুলনা শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তপন কুমার দাশ নিজের পরিবার ও বাড়ির সাত ভাড়াটিয়া পরিবারের ২৩ সদস্যের একটি দল নিয়ে গত ১ ডিসেম্বর তিনদিনের একটি প্যাকেজে সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই বুকিংয়ের টাকা ফেরত নিয়ে এসেছেন তিনি। 

sundarban
সুন্দরবন। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

তপন কুমার বলেন, 'আসলে ভ্রমণের আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে না পারলে তো গিয়ে লাভ নেই। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে কখন কি হয়ে যায় তা বলা যায় না। তাই সবার মতামত নিয়ে ট্যুর ক্যানসেল করেছি।'

এই ভদ্রলোকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে সমৃদ্ধি স্বস্তি দাশের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ৩০ নভেম্বর। তার আগেই বাসার আরও দুই শিশু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সে হিসেবে করেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন তারা।

কিন্তু পরিকল্পনা বাতিলের পর শিশুদের সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তপন কুমার।

খুলনার পর্যটন ব্যবসা মূলত সুন্দরবনকেন্দ্রিক। সাধারণত সুন্দরবন ভ্রমণের মৌসুম শুরু হয় অক্টোবরে; চলে মার্চ মাস পর্যন্ত। এই সময়ের জন্য পর্যটন ব্যবসায়ীরা বছরের বাকি ছয় মাস অপেক্ষা করে থাকেন।

রেইনবো ট্যুর অপারেটর'র স্বত্বাধিকারী শেখ আব্দুল কুদ্দুস জানালেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তার চারটি শিডিউল বাতিল করতে হয়েছে। তিনি বলেন, '৪২ পর্যটককে নিয়ে ডিসেম্বরের ৮ তারিখে সুন্দরবনে যাওয়ার একটি শিডিউল ছিল, যা শেষ মুহূর্তে ক্যানসেল হয়েছে। আগাম বুকিংয়ের টাকাও ফেরত দিতে হয়েছে।'

sundarban
সুন্দরবন | স্টার ফাইল ছবি

এই পর্যটন ব্যবসায়ীর ভাষ্য, এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা গোটানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না তার। তিনি বলেন, 'লঞ্চ ভাড়া, অফিস ভাড়া, স্টাফের বেতনসহ প্রায় লক্ষাধিক টাকা লাগে প্রতিমাসে। অথচ ভরা সিজনে হাত গুটিয়ে বসে আছি। যাদের লাক্সারি শিপ দিয়ে ব্যবসা চালান তারা আরও বিপদে আছেন।'

সুন্দরবনে ভ্রমণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন'র সদস্যসংখ্যা ৫০টিরও বেশি। ওই সব অপারেটরের নৌযান আছে প্রায় ৭০টি। এর মধ্যে ২০টিরও বেশি বিলাসবহুল যান।

অনেক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের সুন্দরবনে পর্যটন প্যাকেজ পরিচালনা করছে। এদের বেশিরভাগ জাহাজ খুলনা থেকেই যাত্রী নিয়ে সুন্দরবনের দিকে যায়। অনেক ট্যুর প্যাকেজ আবার ঢাকা থেকে সরাসরি পর্যটক নিয়ে সুন্দরবনের আসে। সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় বাগেরহাটের মোংলা এলাকা থেকে। 

সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য ট্যুর অপারেটরগুলো সাধারণত তিন দিনের প্যাকেজ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জনপ্রতি সাড়ে সাত হাজার টাকা থেকে শুরু হয় ভাড়া। আর বিলাসবহুল জাহাজে ওই ভাড়া ১৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্যাকেজের আওতায় কেবিন, খাওয়া, বনে ভ্রমণ—সবই অন্তর্ভুক্ত।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৯০ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক ছিলেন মাত্র ৩৯০ জন। পরের অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেন মোট ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৫ জন পর্যটক। তাতে বিদেশি পর্যটক ছিলেন ১ হাজার ১০৩ জন।

sundarban
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুন্দরবনে পর্যটক সংখ্যা কমেছে ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশি পর্যটক ৪৫ শতাংশ এবং বিদেশি পর্যটক বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ২৭৪ জন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। এ সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন মোট ২ লাখ ১৭ হাজার ১৬৯ জন পর্যটক।

২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর গত এক বছরে সুন্দরবন ভ্রমণে দেশি পর্যটক বেড়ে যায় প্রায় ৪৫ শতাংশ। আর বিদেশি পর্যটক বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এতে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিলাসবহুল লঞ্চের জন্য বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে এখন তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

পদ্মা সেতু হওয়ার পর যারা একদিনের ভ্রমণে সুন্দরবনে আসেন তাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হলো করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র। প্রতি বছর সেখানে এক লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। ওই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, আগে ছুটির দিনে পর্যটক আসতেন এক থেকে দেড় হাজার। এখন সেখানে তা ৩০০-৫০০ জনে নেমে এসেছে।

জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আজম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুন্দরবন ভ্রমণের ভরা মৌসুম চলছে এখন। ইতোমধ্যে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এমন সময় প্রত্যেক ছুটির দিনে প্রায় সবগুলো নৌযান পর্যটক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকত। এখন সাত-আটটির বেশি নৌযান বের হচ্ছে না।'

Comments