বর্ণাঢ্য-বর্ণিল শোভাযাত্রায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বছর

শোভাযাত্রার সম্মুখসারিতে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ অতিথিরা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

একটি ক্ষুদ্র পাঠচক্র থেকে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে জন্ম নেওয়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত দিনব্যাপী প্রীতি সমাবেশের সূচনা হয়েছে বর্ণাঢ্য-বর্ণিল শোভাযাত্রার ভেতর দিয়ে।

আজ শুক্রবার সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে এই শোভাযাত্রা শুরু হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে ওঠার পর্যায় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সদস্য, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা এতে অংশ নেন।

শোভাযাত্রাটি বাংলামোটরের ময়মনসিংহ রোডের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

শোভাযাত্রার সম্মুখসারিতে ছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজসহ অতিথিরা। জাতীয় ও গ্রামীণ অনুষঙ্গসহ বিভিন্ন থিমের ওপর ভিত্তি করে মোট ২৩টি অংশে বিভক্ত ছিল শোভাযাত্রাটি।

শোভাযাত্রার বিভিন্ন অংশে ছিল বাংলার ঢাক, চাকমা নৃত্য, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, ভরত নাট্যম, বই শুধু বই, বাদ্যযন্ত্রীর দল, জনপ্রিয় চরিত্র, মণিপুরী নৃ্ত্য, মুক্তিযুদ্ধ, মাছ ধরার দল, বিয়ের দল, সাপুড়ে নৃত্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মারমা নৃত্য, লাঠি খেলা, বাংলার ঢাক, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, পতাকাবাহী দল ও ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি।

গ্রামীণ অনুসঙ্গসহ বিভিন্ন থিমের ওপর ভিত্তি করে মোট ২৩টি অংশে বিভক্ত এই শোভাযাত্রাটি। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

শোভাযাত্রা শেষে কেন্দ্রের সামনের অংশে বসে অতিথিরা ঢোল-বাদ্য সহকারে মনোমুগ্ধকর লাঠিখেলা, নাচসহ বিভিন্ন পরিবেশনা উপভোগ করেন। পরে শুরু হয় আপ্যায়ন পর্ব।

৪৫ বছর পূর্তিতে ময়মনসিংহ রোড সহ পুরো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন সাজানো হয়েছে মনোমুগ্ধকর সাজে। সড়ক ও দেয়ালে আঁকা হয়েছে আলপনা। আলোকচিত্রে এই ৪৫ বছরের যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে একটি প্রদর্শনীতে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের হাত ধরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সেদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে একটি পাঠচক্রে অংশ নিয়েছিলেন মাত্র ১৫ জন মানুষ। তারা প্রতি সপ্তাহে একটি করে বই পড়তেন, বই নিয়ে আলোচনা করতেন।

পরে ধীরে ধীরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এ স্বপ্নযাত্রায় সঙ্গী হন আরও অনেক আশাবাদী মানুষ। প্রসারিত হতে থাকে কেন্দ্র, বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। ইন্দিরা রোড থেকে ১৭ ময়মনসিংহ রোডে চলে আসে কেন্দ্র। এখানেই এক টুকরা সবুজ মাঠের পেছনে জড়ো হতে থাকেন দেশের বহু চিন্তাশীল, উদ্যমী মানুষ।

৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রীতি সম্মেলনের নিমন্ত্রণপত্রে কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শুভাকাঙ্ক্ষীদের উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে লিখেছেন, 'এদিন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা এই সময়-পরিসরের মধ্যে আপনি যতবার খুশি এবং প্রতিবার যতক্ষণ খুশি এই উৎসবে উপস্থিত থেকে আপনার অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য দিয়ে দিনটিকে আনন্দমধুর করে তুলবেন, এই আশা করি।'

আজ সকাল ৯টা থেকেই আগত অতিথিদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন। তাদের আপ্যায়িত করা হয় ভাপা পিঠা, জিলাপি, নাড়ু, মোয়া, গজাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। কেন্দ্রের সদস্য ও কর্মীদের পরে থাকা পোশাকেও চোখে পড়ে ঐতিহ্যের ছাপ। কেন্দ্রের প্রতি তলা সাজানো হয়েছে শোলার তৈরি ফুল-পাখি-লতা-পাতার নানা মোটিফ দিয়ে।

প্রীতি সম্মেলনে অতিথি হয়ে আসা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি অনবদ্য, অনির্বচনীয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান। অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান। আজ প্রতিষ্ঠানটি উদযাপনের যে প্রতিপাদ্য বেছে নিয়েছে তার ভেতর দিয়ে তারা যেমন আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে এনেছে, তেমনি বাংলাদেশের যুব সমাজের সঙ্গে আমাদের উত্তরাধিকারের যে সম্পর্ক সেটাও তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাঙালি সমাজ গড়ে তোলার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমাদের আজ একটা ভরসার জায়গা দেখিয়েছে।'  

১৯৮৪ সাল থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দেশভিত্তিক মানসিক উৎকর্ষ কার্যক্রম শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এর আওতায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বছরে ১৬ থেকে ২৫টি বাছাই বই পড়ানো হয়। এই কার্যক্রমের সাফল্য বাংলাদেশ সরকারকেও উৎসাহিত করেছে। ২০১০ সাল থেকে 'পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি'র আওতায় কেন্দ্রের সঙ্গে মিলে ১২ হাজারের বেশি স্কুলে ৮৩ লাখ ছেলেমেয়ের বই পড়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয়, ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ হাজার প্রশিক্ষণার্থী প্রাথমিক শিক্ষককেও ১২টি করে বই পড়াচ্ছে কেন্দ্র।

শোভাযাত্রা। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি–ব্যবস্থার প্রচলন করে বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা পৃথিবীতেই বিস্ময় জাগিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি (মানে বইভর্তি লরি) এখন ৩০০ উপজেলার তিন হাজার জায়গায় সপ্তাহে অন্তত একবার এক-দুই ঘণ্টা বই দেওয়া-নেওয়া করে।

বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সেরা বইগুলো প্রকাশ করছে তারা। সম্প্রতি 'বাঙালির চিন্তা কর্মসূচি'র আওতায় ১৬টি বিষয়ে ২০০ খণ্ডে ৭৪ হাজার পৃষ্ঠায় জাতির শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মৌলিক চিন্তার এক সংকলন প্রকাশ করেছে কেন্দ্র।

পাশাপাশি সংস্কৃতির অন্য উপাদানগুলোর বিকাশেও কাজ করে চলেছে কেন্দ্র। বিশ্বসাহিত্য ভবনে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ পায় বহু সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন। কেন্দ্র নিজেও নানাবিধ বিষয়ে বক্তৃতা, আলোচনা বা সংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

59m ago