রাজধানীর রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংগুলোর ফায়ার এক্সিটের যে অবস্থা

বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ শপিং মলে ফায়ার এক্সিট না থাকা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঢাকা শহরের অন্যান্য রেস্টুরেন্টেও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। বেইলি রোডে আরেকটি 'রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং' এর ফায়ার এক্সিট নিচতলায় যেখানে নেমেছে সেই জায়গাটি ব্যবহার হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার রাখার কাজে। ছবি: স্টার

বেইলি রোডের মতোই বনানী রোড-১১, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, সাত মসজিদ রোড, খিলগাঁও তালতলা এবং মিরপুর-১১ এর উঁচু ভবনের বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর প্রতিটি তলায় রেস্তোরাঁ, ক্যাফে এবং কমার্শিয়াল কিচেন আছে।

'রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং' হিসেবে পরিচিত এই ভবনগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে।

তবে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড দেখিয়েছে, নিরাপত্তার প্রতি নির্লজ্জ অবহেলা এই ভবনগুলোতে প্রকট।

দ্য ডেইলি স্টার এই 'রেস্তোঁরা ভবনগুলোর' মধ্যে ৩৭টি ঘুরে দেখেছে যেখানে ১০০টিরও বেশি রেস্তোঁরা আছে এবং ২২টি ভবন খুঁজে পেয়েছে যেখানে নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে যা আগুনের ক্ষেত্রে হতাহতের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

ভবনগুলোতে ফায়ার এক্সিট আছে কিনা, সিঁড়িটি আগুন প্রতিরোধক দরজা দিয়ে সুরক্ষিত কিনা এবং সিঁড়িকে স্টোরেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা এসব বিষয় দেখেছেন।

ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'যেহেতু এই ভবনগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয় সেহেতু তাদের অবশ্যই আলাদা ফায়ার এক্সিট থাকতে হবে।'

তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান আইনে রেস্তোরাঁকে অকুপেন্সি ক্যাটাগরি হিসেবে উল্লেখ করা নেই। এটা একটা ফাঁক। আমরা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পরবর্তী সংশোধনীতে এটি বন্ধ করার সুপারিশ করছি।

ধানমন্ডি

সাত মসজিদ রোডে ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা ২১টি 'রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং'  ঘুরে দেখেন এবং এগুলোর মধ্যে আটটিতে নিরাপত্তা ত্রুটি দেখতে পান।

অন্তত আটটি রেস্তোরাঁসহ রাস্তার এক প্রান্তে ১১ তলা ভবনের মূল সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমন পথ দুই জায়গাতেই এলপিজি সিলিন্ডার মজুত করে রাখতে দেখা গেছে।

তৃতীয় তলায় ইমার্জেন্সি এক্সিটে ৪৫ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার এবং ষষ্ঠ তলার মূল সিঁড়িতে দুটি বড় সিলিন্ডার রাখতে দেখা গেছে।

সিঁড়িগুলি বড় বাক্স রাখার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল, যার ফলে জরুরি অবস্থায় কেউ বেরোতে চাইলে এগুলো বাধার কারণ হতে পারে।

এই ভবনের পাশে একটি আটতলা 'রেস্তোঁরা ভবন' এবং একটি ছয় তলা ভবনেও, যেখানে লোকে লোকারণ্য সেখানে কোনো ইমার্জেন্সি এক্সিট নেই।

একটি জনপ্রিয় ১৪ তলা রেস্তোরাঁ ভবনের ৮ ও ১০ তলার সিঁড়ি বড় বাক্স দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে।

১৩তম তলায় আরেকটি ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ ভবনের নিচতলায় ফায়ার এক্সিট দরজা বন্ধ ছিল।

সেখানে আরেকটি জরুরি বহির্গমন পথ থাকলেও সেটি সরাসরি একটি রান্নাঘরের দিকে যায় এবং রান্নাঘরটিতে এলপিজি ব্যবহার করা হয়।

২৭ নম্বর রোডের একটি ১২তলা রেস্টুরেন্ট টাওয়ারের মূল সিঁড়িতে ভাঙা আসবাবপত্র রাখা হয়েছে।

ধানমন্ডিতে একটি রেস্টুরেন্টের নিচতলায় ফায়ার এক্সিট তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। ছবি: স্টার

বনানী

সংবাদদাতারা এই এলাকায় ২১টি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখেছেন তার মধ্যে চারটি উঁচু ভবনে নিয়ম লঙ্ঘন হতে দেখেছেন।

কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে ২১ তলা ভবনটির মাত্র একটি সিঁড়ি রয়েছে যাতে দুইজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটা কষ্টকর।

ভবনের একজন লিফট অপারেটর বলেন, 'আগুন লাগলে সেই সরু সিঁড়িই বাঁচার একমাত্র পথ।'

ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কমপক্ষে তিনটি রেস্তোরাঁ থাকলেও উপরের তলায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

২০১৯ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

রোড-১১ তে পাঁচটি রেস্তোরাঁসহ আরও একটি ১৩ তলা ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি নিরাপদ রাখার জন্য কোনো আগুন প্রতিরোধী দরজা এটির নেই।

দ্বিতীয় তলায় নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে সিঁড়িটি আংশিকভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

এই ভবনের উল্টোদিকে সাতটি রেস্টুরেন্ট নিয়ে ১৩ তলা আরেকটি ভবন রয়েছে। তবে এর কোনো ইমার্জেন্সি এক্সিট বা আগুন প্রতিরোধক দরজা নেই।

বনানীতে ছয়টি রেস্তোরাঁসহ আরেকটি সাততলা ভবনে একটি সরু সিঁড়ি রয়েছে- এবং এই সিঁড়িগুলো চারটি ৪৫ কেজি এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল।

বনানীতে একটি রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়েছে ভাঙা আসবাবপত্র। ছবি: স্টার

খিলগাঁও

তালতলায় একটি পাঁচতলা রেস্তোরাঁ ভবন থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় দোতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত নেমে আসা স্টিলের একটা সিঁড়ি।

আগুন লাগলে এই সিঁড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে।

তিনটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ এবং একটি জনপ্রিয় ইলেকট্রনিক্স দোকানসহ আরেকটি সাত তলা ভবনে মাত্র একটি তিন ফুট চওড়া সিঁড়ি রয়েছে।

ছয়টি রেস্তোরাঁ এবং একটি মিষ্টির দোকানসহ একটি পাঁচ তলা বিল্ডিং এবং তিনটি রেস্তোরাঁসহ একটি তিন তলা ভবনের প্রতিটিতে একটি মাত্র সরু সিঁড়ি রয়েছে।

বেইলি রোড

বেইলি রোডের দ্য ডেইলি স্টার পরিদর্শন করা পাঁচটি ভবনের মধ্যে তিনটিতে নিরাপত্তা সমস্যা ছিল। সেগুলোতে মোট ২৩টি রেস্তোরাঁ আছে।

বৃহস্পতিবার যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল, তার ঠিক পাশেই রেস্তোরাঁ ও ফ্ল্যাটসহ একটি ১৪ তলা ভবন ছিল।

মূল সিঁড়িগুলি দিয়ে ভবনে প্রথম তলা পর্যন্ত যাওয়া যায়। এর উপরের তলাগুলিতে যেতে হলে লিফট ছাড়া উপায় নেই।

ভবনের পেছনের দিকে রেস্তোরাঁর রান্নাঘর সংলগ্ন একটি বের হওয়ার পথ ছিল।

এই সিঁড়ি দিয়ে যদি কেউ বের হয় তাকে বেসমেন্ট দিয়ে বের হওয়ার সরু পথে রাখা বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডারের মুখোমুখি হতে হবে।

কয়েক মিটার সামনে একটি ১০ তলা শপিং মল ও আবাসিক ভবনে একটি ফায়ার এক্সিট থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।

আরেকটি নয় তলা ভবন, যার  নিচতলায় রেস্তোরাঁ এবং তৃতীয় তলা পর্যন্ত দোকান ও অফিস আছে। ‌সেখানেও কোনো নির্দিষ্ট ফায়ার এক্সিট বা দরজা ছিল না।

মিরপুর

মিরপুর-১১ নম্বরে এই পত্রিকার সংবাদদাতারা অন্তত পাঁচটি রেস্টুরেন্টে ঘুরে দেখেছেন এবং তারা সেগুলোতে একাধিক অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন।

ছাদসহ আটতলা একটি ভবনে জরুরি বহির্গমন পথ ছিল না। সেখানে দুটি লিফট এবং একটি সরু সিঁড়ি ছিল।

মিরপুর ১২ নম্বর, একটি ভবনে অন্তত ১৪টি রেস্তোরাঁ তারা দেখেছেন, যেখানে তিন তলা পর্যন্ত কোনো ফায়ার এক্সিট ছিল না। ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে নির্মাণ সামগ্রী রেখে।

জায়মা ইসলাম, আব্দুল্লাহ আব্বাস, মুনতাকিম সাদ, দীপন নন্দী, আরাফাত রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

8h ago