ঢাকাতে আঞ্চলিক খাবারের খোঁজ

আঞ্চলিক খাবার
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ, নবাব চাটগাঁ

ঢাকার খাবারদাবারের চিত্র এখানকার মানুষের মতোই বৈচিত্র্যময়। শুধু তাই নয়, খাবারগুলোর যেন রয়েছে নিজস্ব অভিব্যক্তি। অভিব্যক্তি বলতে বোঝাতে চাইছি, খুব ব্যক্তিগত অনুভূতিপূর্ণ।

এখানে খাবার শুধু খাওয়ার বস্তু নয়, এটি পরিচয়ের এক অংশ হয়ে উঠেছে। দেশের নানা অঞ্চলের সমৃদ্ধ স্বাদ উপভোগ করতে এখন পাহাড় বা নদী পাড়ি দিতে হয় না। কারণ আপনি দেশের যে স্থানেই জন্মগ্রহণ করেন না কেন, এই শহরের কোনো না কোনো কোণায় আপনার শৈশবের ঘ্রাণ লুকিয়ে আছে।

উত্তরের নস্টালজিয়াঃ কালাই রুটি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই সাধারণ কালো মসুর ডালের (মাসকলাই আটা) তৈরি রুটি সাধারণত পোড়া বেগুন, রসুনের ভর্তা বা ঝাল মাংসের সঙ্গে খাওয়া হয়। এই খাবারটি রেস্টুরেন্টের নিয়মিত মেনুতে খুব একটা দেখা যায় না। কালাই রুটি গ্রামীণ, শক্তিশালী স্বাদের পাশাপাশি উত্তরের ঘ্রাণ ছড়ায়। ঢাকার ঝলমলে রেস্টুরেন্টগুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা কিছু ছোট ছোট খাবারের দোকানে আপনি এই রুটি খুঁজে পাবেন। এই দোকানগুলো মুহূর্তেই আপনাকে স্মৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

খিলগাঁওয়ের 'কালাই রুটির আড্ডা'তে বসে এর মালিক রবিউল ইসলাম হাসিমুখে আমাদের বলেন, 'আমি ব্যবসা বিভাগের ছাত্র, আর তাই সবসময় জানতাম নিজে কিছু একটা শুরু করতে চাই। তবে জানতাম না ঠিক কী করব। তারপর এল ২০২০ সাল। পুরো দুনিয়া থেমে গেল। ঘোরাঘুরি একেবারে বন্ধ, আর হঠাৎ করেই আমার খুব কালাই রুটি খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি রাজশাহীর ছেলে। ওই স্বাদ আর উষ্ণতা আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। রাজশাহী, দিনাজপুর বা ওইদিকের কাউকে জিজ্ঞেস করুন। সবাই এই এক কথাই বলবে। তাই পুরোনো দিনের স্বাদের টানে প্রথমে নিজের জন্যই বানাতে শুরু করলাম। এভাবে কলাই রুটি খাওয়ার ইচ্ছা থেকে থেকে ''কালাই রুটির আড্ডা'' জন্ম নিলো।'

চট্টগ্রামের আগুনঃ মেজবান

চট্টগ্রামের মানুষের কাছে মেজবান শুধু এক বেলার খাবার নয়। এটি একটি রীতি এবং একসঙ্গে হওয়ার এক অন্তরঙ্গ উপলক্ষ। ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলার, খোঁজ-খবর নেওয়ার কিংবা প্রিয় মানুষকে আপ্যায়নের জন্যই এর আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে মেজবান শুধু পরিবেশন করা হয় না, এটি অনুভব করানো হয়।

'নবাব চাটগাঁ'র মালিক শহীদুল ইসলাম আসল মেজবানির স্বাদ পরিবেশন করার লক্ষ্যে ঢাকায় তার রেস্টুরেন্টটি খুলেছেন। তিনি চান সবাইকে আসল মেজবানের স্বাদ উপভোগ করাতে। পানসে বা মেজবানের নকল সংস্করণ নয়, তিনি চান ছোটবেলা থেকে যেমন চট্টগ্রামের আসল ঝাল ঝাল মেজবান খেয়ে এসেছেন, সেই স্বাদটাই সবাই উপভোগ করুক।

তিনি বলেন, 'আমি একবার বসুন্ধরায় একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে ওরা যেটাকে মেজবান বলছিল, সেটা আদৌ মেজবান ছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ বইয়ে মেজবান সম্পর্কে পড়ে রেসিপিটা আন্দাজ করে রান্না করেছেন।'

এই অভিজ্ঞতা তাকে ভাবিয়ে তোলে। যদি রাজধানীর মানুষজন সত্যিই মেজবানকে এভাবে চিনে থাকেন তাহলে তো বেশ বিপদ।

তিনি বলেন, 'করপোরেট ক্যারিয়ার ছাড়ার পর ঢাকায় একটা বাঙালি রেস্টুরেন্ট খোলার ভাবনাটা বারবার আমার মাথায় আসছিল। তারপর ভাবলাম আমার এলাকার আসল স্বাদের প্রতি ন্যায়বিচার যদি কেউ করতে পারে, সেটা আমাকেই করতে হবে। নবাব চাটগাঁয় ''খাঁটি'' শব্দটি কোনো মার্কেটিং লাইনের অংশ নয়। এটা আমাদের একটা অঙ্গীকার।'

তিনি নিশ্চিত করেন, তাদের ব্যবহৃত মসলাগুলো সরাসরি হাটহাজারী বাজার থেকে আনা হয়। আর গরুর মাংস? একেবারে ঐতিহ্যগতভাবে ধীরে ধীরে, ধোঁয়া ওঠা মাটির চুলায় কাঠের আগুনে রান্না হয়। কোনো শর্টকাট নয়। কোনো আপস নয়। গর্বের সঙ্গে শুধু গাঢ়, নির্ভেজাল চাটগাঁইয়া স্বাদ।

তিনি যোগ করেন, 'স্বাদটা বাসার মতোই লাগা চাই।' আর সত্যি তাই-ই লাগে।

পাহাড়ের স্বাদ: হেবাং

ঢাকা এখন পাহাড়কেও তুলে এনেছে খাবারের টেবিলে। পাহাড়ি অঞ্চলের তাজা, সুগন্ধিযুক্ত স্বাদের বাহারি রেসিপিগুলো শহরের খাবার সংস্কৃতিতে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা।

এমনই একটি রেস্টুরেন্ট হলো হেবাং। চার বোনের উদ্যোগে পরিচালিত একটি পাহাড়ি খাবারের রেস্টুরেন্ট, যেখানে বাতাসে ভেসে বেড়ায়বাঁশকোড়লের ঘ্রাণ আর ধীরে রান্না করা মাংসের গন্ধ। হেবাংয়ের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালে, অত্যন্ত ছোট পরিসরে। বিশ্ববিদ্যালয় ডরমেটরির বন্ধুরা তাদের বাড়ির রান্না খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু করার উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তারাই।

সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিপলি চাকমা বলেন, 'তারা আমাদের প্রেরণা দিয়েছিলেন। যা কিছু আমাদের রান্নাঘর থেকে শুরু হয়েছিল, তা এক সময় এমন কিছুতে রূপ নেয় যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি।'

২০১৮ সালের মধ্যে হেবাং একটি রেস্টুরেন্ট খুলে ফেলে এবং অচিরেই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাদ্যপ্রেমীরা সেখানে যেতে শুরু করেন। শুধু পাহাড়িরা নন। পাহাড়ের পরিষ্কার, সরল স্বাদের অভিজ্ঞতা নিতে সবাই এখানে যান।

হাজারো স্বাদের এক শহর

ঢাকায় বাস করা মানে হলো এমন সব খাবারের প্রেমে পড়া, যেগুলো আপনি বড় হয়ে ওঠার সময় খাননি। অচেনা স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, অজানা গল্পের খোঁজ পাওয়া, আর প্রতিটি কামড়ে বাড়ির উষ্ণতা খুঁজে পাওয়া- সব মিলিয়ে এটাই ঢাকা শহরের খাদ্যজগতকে বিশেষ মাত্রা দেয়।

একদিন হয়তো আপনি শৈশবের কোনো স্বাদ খুঁজে ফিরছেন, আর পরদিন এমন কিছু খেতে মন চাইছে, যা প্রথম খেয়েছিলেন মাত্র গত বছর। কিন্তু এখন সেটা ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। আর এখানেই আছে এক টুকরো জাদু। ঢাকা শহর আপনাকে সংযুক্ত করে আপনার শেকড়ের সঙ্গে, আশপাশের মানুষের সঙ্গে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh GDP growth vs employment

Economy expanded 50% in eight years, but jobs grew only 11%

Over the past eight years until fiscal year 2023-24, the country’s economy grew by more than 50 percent, painting a rosy picture of performance by major sectors, while the expansion did not translate into job creation.

12h ago