মই সরলেও লাফ দিয়ে ও ভ্যানে উঠে চলছে পারাপার, জীবনঝুঁকির আরেক নাম শিমরাইল

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইলে বাস থেকে যাত্রীদের মাঝের লেনে নামিয়ে দেওয়া হয়। যাত্রীরা উঁচু সড়ক বিভাজক পার হতে না পারায় হাইওয়ে পুলিশ ভ্যানগাড়ি ডেকে তাদের পারাপারের ব্যবস্থা করে। ছবিটি আজ মঙ্গলবার দুপুরে তোলা। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জ অংশের শিমরাইল মোড়ে যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলে মহাসড়কের মাঝে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা চলছেই। বাস থেকে নামা যাত্রীদের মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ৪ ফুট উঁচু সড়ক বিভাজক লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে।

মহাসড়কের এই অংশে মই দিয়ে যাত্রীদের টাকার বিনিময়ে সড়ক বিভাজক পার করে দেওয়ার একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মইসহ এক যুবককে আটক করে পুলিশ।

কিন্তু, সেখানে এখনো যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হয়নি। 

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে সড়ক বিভাজক পার হচ্ছেন এক যাত্রী। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

আজ মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া যাত্রীরা যখন সড়ক বিভাজক পার হতে পারছিলেন না, তখন হাইওয়ে পুলিশকে একটি ভ্যানগাড়ি ডেকে যাত্রীদের বিভাজক পার করে দিতে হয়েছে।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত মহাসড়কে দাঁড়িয়ে অন্তত ১৭টি দূরপাল্লার বাসের যাত্রীদের সড়কের পাশের লেনে না নামিয়ে মাঝের দ্রুতগামী গাড়ির লেনে নামাতে দেখা গেছে। 

আট লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝের চারটি লেন বিরতিহীনভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। 

এই চার লেনের সঙ্গে দুই পাশে যাত্রী ওঠানামার দুটি করে সার্ভিস লেন আছে। মাঝখানে আছে উঁচু সড়ক বিভাজক।

পুলিশের ডেকে আনা ভ্যানগাড়িতে সড়ক বিভাজক পার হচ্ছেন কয়েকজন যাত্রী। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

মাঝের লেনে নামিয়ে দেওয়া যাত্রীদের সার্ভিস সড়কে যেতে হলে অন্তত এক কিলোমিটার আগে কাঁচপুর সেতু সংলগ্ন কিংবা এক কিলোমিটার পরে মাদানীনগর এলাকায় সড়কের কাটা অংশ দিয়ে হেঁটে পার হতে হবে। 

নিয়ম অনুযায়ী, বাসগুলোকেও শিমরাইলে যাত্রী নামাতে হলে ওই দুই অংশ দিয়ে সার্ভিস লেনে প্রবেশ করতে হয়। মাঝের চার লেনে যাত্রী ওঠানামার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু ঢাকাগামী যানবাহনগুলো যাত্রী নামানোর নির্ধারিত লেনে না ঢুকে মাঝের লেন দিয়ে এসে শিমরাইলে যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে।

বাধ্য হয়ে এই যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে উঁচু সড়ক বিভাজক পার হতে হচ্ছে।

হাইওয়ে পুলিশ বলছে, মামলা দিয়েও মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। বাসচালকসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা তৈরি না হলে এটি থামানো কঠিন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং হাইওয়ে পুলিশ জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের দ্রুতগামী (ভিআইপি) ও সার্ভিস লেনের মাঝের সড়ক বিভাজকটি আগে আরও নিচু ছিল। শিমরাইল মোড়ে একটি পকেট গেটও ছিল। মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানো বন্ধ করতে এক বছর আগে সড়ক বিভাজকটি উঁচু করা হয়েছে। তিনমাস আগে পকেট গেটটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও বাসগুলো সেখানে যাত্রী নামাচ্ছে। 

পুলিশের সামনেই সড়কের মাঝে যাত্রী ওঠানো-নামানো চলছে। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

আজ দুপুর ১টার দিকে দুটি বাসের যাত্রীদের মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দিতে দেখা যায়। কাছেই দুটি বাসের বিরুদ্ধে মামলা করতে ব্যস্ত ছিল হাইওয়ে পুলিশ।

এ সময় মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দেওয়ায় শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তাসলিমা বেগম। আঁখি এক্সক্লুসিভ বাসের কর্মীদের সঙ্গে তর্কেও জড়াতে দেখা যায় ওই নারীকে। পরে পুলিশ এসে ওই বাসটির বিরুদ্ধেও মামলা দেয়।

তাসলিমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই জায়গায় নামিয়ে দিছে বাসের লোকজন। পুরুষ মানুষ তারপরও লাফাইয়া যাইতেছে। এইখান দিয়া আমি বাচ্চা নিয়ে কীভাবে পার হবো বলেন তো দেখি?'

আরেক যাত্রী রবিন আহমেদ বলেন, 'বাসের চালক ইচ্ছা করে মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দেয়। ডিভাইডার দিয়ে লাফিয়ে পার হতে গিয়ে কে কখন গাড়ির নিচে পড়ে তার কোনো চিন্তা নেই ওদের। পুলিশের সামনেই এই কাজ করে তারা।'

উঁচু সড়ক বিভাজক পার হতে না পেরে অন্তত সাতজন নারীকে মহাসড়কের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ভ্যানগাড়িতে উঠে বিভাজক পার হন তারা।

মহাসড়কের এই অংশে কয়েকদিন আগে যাত্রীদের টাকার বিনিময়ে মই দিয়ে বিভাজক পার করিয়ে দেওয়ায় আটক করা হয় এক যুবককে। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

তিন বছর বয়সী শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মহাসড়কের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় সাজু আহমেদকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মাঝখানে বাস থামিয়ে নামিয়ে দিয়েছে। বাচ্চা নিয়া তো উঁচু ডিভাইডার পার হতে পারব না। সামনে নাকি সড়কের এক জায়গায় কাটা আছে, ওইখান দিয়ে রাস্তা পার হব। এইভাবে ব্যস্ত হাইওয়ের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়াটাও তো রিস্কি। এইগুলো থামাবে কে?'

তবে অন্তত তিনটি বাসের চালক ও স্টাফদের সঙ্গে কথা হলে তারা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেন। তাদের অভিযোগ, পাশের সার্ভিস লেনের অর্ধেকটাতে অবৈধ পার্কিং থাকে। এতে সার্ভিস লেন দিয়ে বাস নিয়ে গেলে যানজটে পড়তে হয়। 

অনেক সময় যাত্রীরাও তাদের পছন্দমতো জায়গায় নামতে চান বলে অভিযোগ বাসের কর্মীদের।

মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানোয় শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের একটি বাসের বিরুদ্ধে মামলা দেয় পুলিশ। চট্টগ্রাম থেকে আসা এই বাসের সুপারভাইজার আবির হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সার্ভিস লেনে সারাক্ষণ জ্যাম হয়ে থাকে। যাত্রীরা নির্ধারিত স্টপেজে নামতে চান না। রাস্তা ক্লিয়ার থাকলে আমাদের যাত্রী নামাতে অসুবিধা নাই।'

জানতে চাইলে শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের উপপরিদর্শক (এসআই) নূর মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এইখানে মূলত দুইটা লেন, একটা মাঝের ভিআইপি, আরেকটা পাশের সার্ভিস লেন। বাসের যাত্রীদের সার্ভিস লেনে এসে যাত্রী নামানোর কথা। কিন্তু বাসচালকরা তাদের সুবিধার্থে ভিআইপি লেনেই যাত্রী নামিয়ে দেয়। এতে ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরা।'

তিনি বলেন, 'মহাসড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা কাজ করছি। এরকম ঘটনা পেলেই বাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করছি।'

গত রোববার থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত মহাসড়কের নির্ধারিত স্থানে যাত্রী না নামিয়ে মাঝখানে নামানোয় ৭৮টি বাসের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে বলে জানান শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. শরফুদ্দিন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিমরাইল মোড়ে আমাদের দুইজন পুলিশ নিয়মিত থাকে। তারপরও একটি মোবাইল টিম গত কয়েকদিন ধরে পার্মানেন্টভাবে রেখেছি, বাসগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। কিন্তু কোনোভাবেই বাসের এই কার্যক্রম থামানো যাচ্ছে না। পরিবহন সংশ্লিষ্ট লোকজন যদি সচেতন না হয় তাহলে তো মামলা দিয়ে এসব থামানো কষ্টকর।'

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago