সড়ক প্রকল্পে উপেক্ষিত ‘সেফটি অডিট’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর রোড সেফটি অডিট ছাড়াই দুই লেনের মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে সড়ক নিরাপত্তার ঝুঁকি উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
৬৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৮৩৫ কিলোমিটার মহাসড়ক সম্প্রসারণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১২টি প্রকল্প রয়েছে। যার মাত্র তিনটির নকশা পর্যায়ে সেফটি অডিট করা হয়েছিল।
একটি প্রকল্পের নিরীক্ষা করেছিল অধিদপ্তর নিজেই, বাকি দুটি করেছিল অর্থদাতা প্রতিষ্ঠান।
সড়ক নির্মাণের সময়, নিরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, 'এর অভাবে সম্প্রসারিত এসব সড়ক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।'
তিনি বলেন, নকশা, বাস্তবায়ন এবং নির্মাণ পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন নিরীক্ষকদের দিয়ে সেফটি অডিট করানো উচিত।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর মাত্র ১,০৫৫ কিলোমিটার সড়কের সেফটি অডিট চালিয়েছে, যার অর্থ ২২,৪৭৬ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ৯৫ শতাংশেরও বেশি সড়কের কখনও অডিট করা হয়নি।
রোড সেফটি অডিট পদ্ধতিগত, আনুষ্ঠানিক এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন যা বিদ্যমান বা পরিকল্পিত সড়কের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে এবং দুর্ঘটনা হ্রাস করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।
নিরাপত্তার বিষয়ে এ ধরনের ঘটনা এমন সময়ে ঘটছে যখন প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫ হাজার ৪২৫টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৫ হাজার ২৪ জন নিহত হয়েছেন। তবে কয়েকজন সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনকর্মী জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের নকশায় ত্রুটি দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সড়কের নকশা, নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
রোড সেফটি অডিটের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তাদের নির্দেশিকা আপডেট করছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ হলেই সড়কে বড় মাপের অডিট শুরু করবে সংস্থাটি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী, সওজের রোড ডিজাইন অ্যান্ড সেফটি সার্কেল জাতীয়, আঞ্চলিক ও মহাসড়ক এবং সেতুগুলোর অডিট করবে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, রাস্তা প্রশস্ত করা হলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে এখানে সেফটি অডিট অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সড়কে যথাযথ সেফটি অডিট করা হয়নি।
তিনি বলেন, প্রশস্ত রাস্তায়, গাড়িচালকরা দ্রুত গাড়ি চালান এবং এর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ে।
তিনি বলেন, যেহেতু সময়ের সাথে সাথে সড়কের চারপাশের পরিবেশ পরিবর্তিত হয়, তাই বিদ্যমান সড়কগুলোতে যুক্তিসঙ্গত সময়ের বিরতিতে রোড সেফটি অডিট করা উচিত।
সেফটি অডিট ছাড়াই সড়ক সম্প্রসারণ
বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রায় ৮০০ সড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে কমপক্ষে ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এ সড়কগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-সিলেট ২১০ কিলোমিটার, টাঙ্গাইল (এলেঙ্গা)-রংপুর ১৯০ কিলোমিটার, যশোর-ঝিনাইদহ ৪৮ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল ৫৬ কিলোমিটার, আখাউড়া-আশুগঞ্জ ৫১ কিলোমিটার, কুমিল্লা (ময়নামতি)-ব্রাহ্মণবাড়িয়া (ধরখার) ৫০ কিলোমিটার, সিলেট-শেওলা ৪৩ কিলোমিটার, পাঁচদোনা-ঘোড়াশাল ২০ কিলোমিটার, ফেনী-নোয়াখালী ৫০ কিলোমিটার, কুমিল্লা-নোয়াখালী ৫৯ কিলোমিটার, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা ১০ কিলোমিটার সড়ক এবং ঢাকা বাইপাসের ৪৮ কিলোমিটার ।
সওজ সূত্র জানায়, শুধুমাত্র ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, সিলেট-শেওলা মহাসড়ক, এবং ঢাকা বাইপাস রোডের নকশা পর্যায়ে রোড সেফটি অডিট করা হয়েছে।
সওজ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অডিট করে। নিরীক্ষকদের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ব্যস্ত মোড়ে ওভারপাস যুক্ত করা যার জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা না থাকায় সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে কি না তা অনিশ্চিত।
সিলেট-শেওলা প্রকল্পে অর্থায়নকারী হিসেবে অডিট করেছে বিশ্বব্যাংক। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে বাস্তবায়নাধীন ঢাকা বাইপাস সড়ক প্রকল্পে বেসরকারি অংশীদাররা এই প্রকল্পের নিরীক্ষা করেছে।
১২টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বিদেশি ঋণে, একটি পিপিপির আওতায় এবং চারটি সরকারি তহবিলে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ডেইলি স্টার প্রতিবেদক ১২টি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গেই কথা বলেছে।
তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে একটি পৃথক প্রকল্পের আওতায় এখন যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তার বেশিরভাগের সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ নকশা করা হয়েছে।
কিন্তু এডিবির অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে সেফটি অডিটের বিধান ছিল না বলে জানান তারা।
চলমান প্রকল্পের অধীনে নিয়োগকৃত পরামর্শদাতারা নকশার কিছু পর্যালোচনা করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে সড়ক নিরাপত্তায় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। তবে সড়ক নিরাপদ করার জন্য এগুলোই যথেষ্ট নয়।
এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ শতাংশ অডিট
সওজের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক রয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের রোড সেফটি অডিট করে। সেসময় পাঁচটি জাতীয় মহাসড়কের ৫০০ কিলোমিটার নিরীক্ষা করা হয়।
নিরাপত্তা ইস্যু সমাধানের জন্য সুপারিশ করার পাশাপাশি, অডিট রিপোর্টে অবশিষ্ট জাতীয় মহাসড়কের সেফটি অডিট সম্পূর্ণ করার জন্যও বলা হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তিনটি মহাসড়কের ৩০০ কিলোমিটার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই মহাসড়কের ২৫৫ কিলোমিটার অডিট করে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সড়ক নকশা ও নিরাপত্তা সার্কেল) তানভীর সিদ্দিক বলেন, জাতীয় মহাসড়ককে অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যায়ক্রমে সেফটি অডিট করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মানবসম্পদ ও তহবিলের অভাবই বেশি অডিট না হওয়ার প্রধান কারণ।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান বলেন, নকশা পর্যায়ে অডিটের চেয়ে নির্মাণ পরবর্তী সেফটি অডিট বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি গত সপ্তাহে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা নির্মাণ-পরবর্তী নিরীক্ষার ওপর বেশি জোর দিচ্ছি।'
তিনি বলেন, সেফটি অডিটে যথাযথ দক্ষ লোকের মারাত্মক অভাব রয়েছে।
তবে আমরা শিগগিরই বড় আকারের (সেফটি অডিট) কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা করছি।
পরিকল্পনা কী?
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এখন সেফটি অডিটের জন্য চেকলিস্টসহ একটি ম্যানুয়াল তৈরি করছে।
ঢাকা-সিলেট প্রকল্প পরিচালক এ কে মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, আমরা প্রকল্পের জন্য রোড সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করতে চাই।
তিনি বলেন, সেফটি অডিট করার জন্য তারা একটি রোডম্যাপও তৈরি করছেন।
তিনি বলেন, যেমন কোন রাস্তা আগে অডিট করা হবে এবং সেফটি অডিটের জন্য যোগ্য হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে সার্টিফিকেট দেওয়ার পদ্ধতি কী হবে, তা রোডম্যাপে উল্লেখ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ম্যানুয়াল ও রোডম্যাপের খসড়া ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
Comments