সড়ক নিরাপত্তার প্রতিটি ধাপেই ত্রুটি

পরপর দুটি বড় দুর্ঘটনা, যা গত দুই দিনে অন্তত ২৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এই গভীর সংকটেরই নির্মম প্রকাশ

পুরো সড়ক পরিবহন খাতই দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত, যা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

পরপর দুটি বড় দুর্ঘটনা, যা গত দুই দিনে অন্তত ২৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এই গভীর সংকটেরই নির্মম প্রকাশ।

বাণিজ্যিক পরিবহনের চালকদের কথা যখন আসে তখন দেখা যায়, তাদের কেবল যে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাব আছে তাই নয়, তারা তাদের কাজের সময়ের চেয়েও অনেক বেশি শ্রম দেয় বলেও উঠে এসেছে।

বিপুলসংখ্যক যানবাহনেরই নিবন্ধন এবং বাধ্যতামূলক ফিটনেস ছাড়পত্র নেই। আর যেসব পরিবহনের আছে সেগুলোর বেশিরভাগের ফিটনেস ছাড়পত্রও প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে, বেশিরভাগ সড়কের রোড সেফটি অডিট করা হয় না এবং এসব সড়কের একটা বড় অংশের অবস্থাই নাজুক এবং এতে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পট রয়েছে। আর সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা এসব সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

শুধু সক্ষমতা ও জনবলের ঘাটতিই নয়, তাদের অনেক কর্মকর্তাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থেকে সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।

এদিকে এ অবস্থার সুফল পাওয়া কিছু স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থে অবস্থা যেমন আছে তেমনই রাখতে চায়।

সড়ক বিশেষজ্ঞ, সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনকারী, পরিবহন নেতা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্য ডেইলি স্টার এই সিদ্ধান্তে এসেছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব দ্রুত এ বিষয়ে কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ না নিলে আমরা এই পরিস্থিতি থেকে নিজেদেরকে পরিত্রাণ দিতে পারব না। আমরা যদি এটি করতে ব্যর্থ হই, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকবে।'

গত মঙ্গলবার ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ জনসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় জড়িত বাসটির কোনো রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ বা ট্যাক্স টোকেন ছিল না এবং যে পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে সেটিও অবৈধভাবে যাত্রী বহন করছিল।

গতকাল ঝালকাঠিতে একটি ট্রাক বেশ কয়েকটি যানবাহনকে চাপা দিলে নিহত হয় আরও ১৪ জন।

এই ট্রাকচালকেরও কোনো বৈধ লাইসেন্স ছিল না।

সমস্যার মূল

বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রায় সব চালক গাড়ি চালানোর কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেন না, এর পরিবর্তে তারা তাদের সিনিয়রদের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শেখেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পেশাদার চালকদের একদিনের 'রিফ্রেশার' প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রতি পাঁচ বছর পর পর লাইসেন্স নবায়ন করে, যা অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক চালক ঠিকমতো পরীক্ষা না দিয়েই লাইসেন্স পান, আবার কারও কারও কাছে বৈধ কোনো লাইসেন্সই নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের জুন মাসে মহাসড়কে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তবে তার নির্দেশনা অনেকাংশেই উপেক্ষা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশিরভাগ চালকই অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকেন।'

'একটানা আট থেকে দশ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয় তাদের। অনেক ক্ষেত্রে যানজটের মধ্যেই তাদের কাজ করতে হয়। এতে মনোযোগ নষ্ট হয়। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকার চালকদের জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে না তবে প্রায়শই সঠিক তদন্ত ছাড়াই দুর্ঘটনার জন্য তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।'

এছাড়া অনেক চালকের চোখের সমস্যা রয়েছে, যা সড়কে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।

এদিকে বছরের পর বছর ধরে ফিটনেস ছাড়পত্র ছাড়া নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে।

১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ দশমিক ১৭ লাখ যানবাহনকে বাধ্যতামূলক ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়নি। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এই সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৭৯ লাখ।

অন্যদিকে বিআরটিএ যে ছাড়পত্র দিয়েছে তার মান নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়।

সংস্থার শুধুমাত্র একটি যানবাহন পরিদর্শন মেশিন রয়েছে, যার অর্থ বেশিরভাগ যানবাহন ম্যানুয়ালি পরীক্ষা করা হয়। সবমিলিয়ে প্রায় ১৪০ জন পরিদর্শক থাকায় সব গাড়ি ভালোভাবে চেক করা প্রায় অসম্ভব।

যেহেতু সরকার বাণিজ্যিক যানবাহন কতদিন সড়কে চলতে পারবে তা এখনও কার্যকর করতে পারেনি, আর তাই হাজার হাজার পুরোনো যানবাহন এখনও সড়কে চলাচল করছে।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন ও জেলা সদরে বেশিরভাগ ট্রাফিক পুলিশ নিয়োজিত থাকায় তাদের সংখ্যারও অভাব রয়েছে।

তবে মূল সমস্যা হচ্ছে, অনেক পরিবহন মালিক-শ্রমিক মনে করেন, বিআরটিএ থেকে বৈধ কাগজপত্র নেওয়া অপ্রয়োজনীয়, কারণ তারা ঘুষ দিলে সহজেই সড়কে গাড়ি চালাতে পারেন।

লাইসেন্সবিহীন অনেক চালক পরিবহনখাতে আধিপত্য বিস্তারকারী অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশকে প্রতি মাসে ঘুষ দিয়ে চলাচলের অনুপযোগী যানবাহন সড়কে চালায় বলে জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ সূত্র।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় অনেক ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করছে।

তিনি গতকাল রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এবং এতে করে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।'

অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্যিক ও ছোট যানবাহনের অধিকাংশ চালকের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। তাদের দায়িত্ববোধেরও অভাব রয়েছে, যা সাধারণত প্রশিক্ষণের সময় তারা বুঝতে পারেন।'

'সুতরাং, সড়কে একটি নৈরাজ্যিক ড্রাইভিং সংস্কৃতি বিরাজ করছে, যা আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাবে প্রতিদিনই অবনতি হচ্ছে।'

'বড় ধরনের কোনো সড়ক দুর্ঘটনার পর, আপনি দেখতে পাবেন যে জড়িত যানবাহন বা চালকদের বৈধ কাগজপত্র ছিল না। তারা এসব গাড়ি চালানোর জন্য কাকে টাকা দেয়?' প্রশ্ন রাখেন তিনি।

'এই সমস্ত তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে, সড়ক খুবই অনিরাপদ। এটি একটি অ্যাটম বোমার মতো।'

তিনি বলেন, 'রাস্তার উন্নতির সাথে সাথে গাড়ির গতিও বাড়ছে, যার অর্থ বৈপ্লবিক কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকবে।'

ওসমান আলী চালকদের জন্য মনিটরিং বৃদ্ধি, আইনের প্রয়োগ ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুপারিশ করেন। অন্যদিকে রাঙ্গা বলেন, ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ যানবাহন চলাচল সীমিত করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি বড় সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

The invisible ones

Of the over 7 crore people employed in Bangladesh, 85 percent (nearly 6 crore) are vulnerable as they work in the informal sector, which lacks basic social and legal protection, and employment benefits.

6h ago