বাংলাদেশ

টিকিট না কাটায় পাঁচ শিশুকে সবার সামনে কান ধরিয়ে রাখলেন ইউএনও

পরে রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে তিন শিশুকে ছেড়ে দেওয়া হলেও দুজনকে আরও এক ঘণ্টা গ্রাম পুলিশ ও আনসার সদস্যদের পাহারায় আটকে রাখা হয়।
শরীয়তপুর পার্ক। ছবি: স্টার

শরীয়তপুর শিশুপার্কে ৩০ টাকার টিকিট না কেটে ঢোকায় দর্শনার্থীদের সামনে পাঁচ শিশুকে শাস্তি দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

সেসময় পাঁচ শিশুর মধ্যে চারজনকে পার্কের মধ্যে দীর্ঘ সময় কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি।

গতকাল সোমবার রাত ৮টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।

পরে রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে তিন শিশুকে ছেড়ে দেওয়া হলেও দুজনকে আরও এক ঘণ্টা গ্রাম পুলিশ ও আনসার সদস্যদের পাহারায় আটকে রাখা হয়। শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিনের নির্দেশ ও উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে।

আটকে রাখা শিশুদের বয়স ৭ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে।

গত রাত ৮টার দিকে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক ওই পার্কে এ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে দেখা যায়, রাত ৮টার দিকে পুলিশ এবং ইউএনওর ব্যক্তিগত আনসার সদস্যরা চার শিশুকে আটকে পার্কে ইউএনওর কাছে নিয়ে আসেন। পার্কের পূর্ব পাশে একটি কড়ই গাছের সামনে ওই শিশুদের দর্শনার্থীদের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন ইউএনও। সেই সময় তাকে শিশুদের দিকে রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলতে দেখা যায়।

একসময় গ্রাম পুলিশ ও আনসার সদস্যদের উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়, বাবা-মা না আসা পর্যন্ত তাদেরকে ছাড়বে না।

ঘটনার সময় পার্কে উপস্থিত অনেক দর্শনার্থী তাদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলেন ও ভিডিও ধারণ করেন।

দীর্ঘ সময় এভাবে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখায় অন্যান্যরা হাসাহাসি করলে একটি শিশু কেঁদে বলে, 'স্যার আমাকে ছেড়ে দেন, আমি আর কখনো এইখানে ঢুকব না।'

ইউএনও মাইনউদ্দিন সেসময় শিশুটিকে বলেন, দেয়াল টপকে প্রবেশ করা অপরাধ। এটা চুরির সমান অপরাধ। এই কাজ যেন আর কখনো করতে না দেখি। তারপর শিশুটিকে ছেড়ে দেন তিনি। তখন আরও এক শিশুকেও ছেড়ে দেওয়া হয়।

পরে আরেক শিশুকে ডেকে তার চুল নেড়েচেড়ে দেখেন ইউএনও। চুল এত বড় কেন জানতে চান। সঙ্গে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে শিশুটিকে ছেড়ে দেন। ওই সময় সশস্ত্র আনসার সদস্যরা সাদা রঙের গেঞ্জি পরা এক শিশুকে ধরে নিয়ে আসেন। পরে তাকে আরেক শিশুর সঙ্গে কড়ই গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। গ্রাম পুলিশ সদস্যদের পার্ক বন্ধ হওয়ার এক ঘণ্টা পর তাদেরকে ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে পার্ক ছেড়ে যান ইউএনও।

পরে রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে পার্ক বন্ধ করার সময় গ্রাম পুলিশ সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে ওই দুই শিশু তাদের চোখ এড়িয়ে পার্ক থেকে বের হয়ে যায়।

কেন আটকে রাখা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে শরীয়তপুর জেলা শহরের একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাজীব (ছদ্মনাম) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি পার্কের দেয়ালের ওপর বসে খেলছিলাম। খেলতে গিয়ে পার্কের মধ্যে পড়ে যাই। তখন আনসার সদস্যরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাকে লাল শার্ট পরা (ইউএনও) একজনের সামনে নিয়ে যায়। দেখি কয়েকজনকে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। পরে আমাকেও আরেক জনের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রাখে। তখন ওই স্যার বলেন, ওদেরকে শিশু পার্ক বন্ধ হওয়ার এক ঘণ্টা পর ছাড়বে, কোনোভাবেই এর আগে ছাড়বে না। অন্য একজন বলে এই দুইজনকে চার-পাঁচটা পিটান (পিটুনি) দিয়ে ছেড়ে দাও। এই সময় আমার স্কুলের আরেক বন্ধু আমাকে দেখে অনেক হাসে। এখন যদি সে স্কুলে সবাইকে গিয়ে বলে, স্কুলের সবাই আমাকে দেখে হাসবে। তারচেয়ে ভালো আমি আর স্কুলে যাব না। কয়েকজনের কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়ে টিকিট কাটার পর অন্যদের ছেড়ে দিয়েছে। আমার পকেটে থাকা ২০ টাকা দিয়ে ছাড়া পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ছাড়েনি।'

শিশুটির বাবা ডেইলি স্টারকে বলেন, ছেলে বাসায় এসে কান্নাকাটি করছিল। ভয়ে কিছু বলতে চাইছিল না। পরে তাকে আশ্বস্ত করলে জানায় টিকিট ছাড়া পার্কে ঢুকেছিল, তাই তাকেসহ কয়েকজন শিশুকে কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এসব দেখে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করেছে। এখন সে বলছে সে আর স্কুলে যাবে না।

'আমার ছেলে কোনো অপরাধ করে থাকলে ইউএনও আমাকে জানাতে পারতেন। গরিব বলে হয়তো আমার ছেলেকে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখল', বলেন তিনি।

শিশুদের কেন আটক রাখা হয়েছে—গতকাল রাতে জানতে চাইলে গ্রাম পুলিশ সদস্য জসিম মৃধা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাচ্চাগুলা দেয়াল টপকে টিকিট ছাড়া পার্কের মধ্যে ঢুকেছিল। তাই ওদের ইউএনও স্যারের নির্দেশে আটকে রাখা হয়েছে।'

শিশু দুটোকে কখন ছাড়বেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তখন তিনি বলেন, 'মেলা শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পর স্যার ছাড়তে বলছেন।'

টিকিট না কেটে পার্কে প্রবেশ করার কারণে শিশুদের জনসম্মুখে দীর্ঘ সময় কান ধরিয়ে দাঁড় করে রাখতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিন বলেন, 'আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ আছে যে, আমি শিশুদেরকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি?'

ভিডিও ডকুমেন্ট আছে জানানো হলে তিনি ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, 'ওই শিশুদের কান ধরিয়ে রাখার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি কাউকে কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখিনি।'

তিনি বলেন, 'কয়েকজন শিশু দেয়াল টপকে ঢুকেছিল। তারপর পাশে যারা ছিল তারা তাদের ধরে এনেছে। ওরা দাঁড়িয়ে ছিল, ভয়ে হয়তো কানে হাত দিয়েছে। তখন আমি তাদেরকে বলেছি কান থেকে হাত নামাও। আমি তাদের (শিশুদের) বলেছি দেয়াল টপকে প্রবেশ করা অপরাধ। এটা চুরির সমান অপরাধ। তোমরা আর কখনো এ কাজ  করবে না। সৎ ও ভালো মানুষ হয়ে জীবনযাপন করবা। এমন কথা বলে আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি। আর দুই শিশুকে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনাটি আমার জানা নেই। আর আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, এই বিষয়ে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের কোনো অবহেলা আছে কি না।'

টিকিট ছাড়া প্রবেশের কারণে ইউএনও শিশুদের সঙ্গে অসম্মানসূচক-অমানবিক কাজ করতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ টেলিফোনে আজ দুপুরে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে ইউএনওর নাম কেন আসছে? তিনি তো সবসময় সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। আর ঘটনার সময় সেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন কি না? আর তার নির্দেশে শিশুদেরকে কান ধরে দাঁড় করে রাখা হয়েছে কি না?'

ইউএনওর উপস্থিতি এবং কার্যক্রমের ভিডিও ডকুমেন্ট রয়েছে জানানো হলে জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, 'ঠিক আছে আমাকে সময় দিন। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি প্রকৃত ঘটনা কী।'

শরীয়তপুর আদালতে শিশু ও কিশোর অপরাধ নিয়ে কাজ করেন আইনজীবী তৌহিদ কোতোয়াল।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, শিশুদের মন কোমল ও নরম হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে নমনীয় আচরণ করতে হবে। আর তাদের জন্য দেশে আলাদা আইন, আলাদা আদালত করা হয়েছে। তারা কোনো অপরাধ করলে আদালত তাদের অপরাধের বিচার করবে। কিন্তু জনসম্মুখে তাদেরকে কোনো অপরাধের শাস্তি কেউ দিতে পারবে না। জনসম্মুখে কোনো শাস্তির ঘটনা ঘটলে শিশুটি একটি বিক্ষিপ্ত মনোভাব নিয়ে বড় হবে। যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

উল্লেখ্য, স্থানীয়দের সহযোগিতায় শরীয়তপুর জেলা শহরে সদর হাসপাতালের সামনে ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির পাশে পার্ক নির্মাণ করেছে জেলা প্রশাসন। 'শরীয়তপুর পার্ক' নামকরণ করা পার্কটি ঈদের দিন চালু করা হয়। পার্কটিতে শিশুদের খেলার জন্য ১৫-১৬টি বিভিন্ন রাইড বসানো হয়েছে। পার্কের প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা।

পার্কের দেখভালের দায়িত্বে আছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিন, পার্কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কয়েকজন গ্রাম পুলিশ ও আনসার সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে।

Comments