অর্থনৈতিক সংকটে ডিসি-ইউএনওদের জন্য এত দামি এসইউভি কেন?

অর্থনীতির এমন সংকটকালীন পরিস্থিতির ভেতর এই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিনিয়োগ, রাজস্ব আয় কিংবা কর্মসংস্থানের মতো সূচকগুলোর অবস্থা নিম্নগামী। বাড়ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে এখনো হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এয়ারলাইনস ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচ্ছেন না।

পাশাপাশি বাংলাদেশের গত দুই মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার খবরে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে ওঠার আশঙ্কার মধ্যেও জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য ২৬১টি স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) কেনা হচ্ছে। যার প্রতিটির মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ জন্য সবমিলিয়ে খরচ ধরা হয়েছে ৩৮১ কোটি টাকা। সম্প্রতি টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় এই খরচ আরও বাড়বে।

প্রশ্ন উঠেছে—অর্থনীতির এমন সংকটকালীন পরিস্থিতির ভেতর এই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের সঙ্গে।

এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসব গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়।

বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমি মনে করি তখন যেসমস্ত যুক্তিতে এটা স্থগিত করা হয়েছিল সেগুলো আরও বেশি সুদৃঢ় হয়েছে এখন। দেশের সার্বিক যে অর্থনৈতিক অবস্থা, এর যে নেতিবাচক প্রভাব সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে, জনগণের ওপর—তাতে এমন সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক হতে পারে না। বরং বাস্তব অর্থে এটি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, জনগণের অর্থের অপচয়। আর জনগণের অর্থে বিলাসিতা কোনো রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকেই প্রত্যাশিত না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য।'

এ অবস্থায় এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। বলেন, 'যে পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই সুবিধা পেতে যাচ্ছেন, তারা যানবাহন পাবেন না—সেটা আমরা কখনোই বলব না। এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে যাদের যানবাহন আছে সেটা বাতিল করার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি না, থাকলে সেটা কেন করতে হবে, সেই মানদণ্ডগুলো বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।'

এছাড়া কেন বিলাসবহুল এসইউভিই কিনতে হবে—এমন প্রশ্ন রেখে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'এমনিতেই এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিয়ে অনেকের ভেতর উদ্বেগ আছে, উৎকণ্ঠা আছে। এ ধরনের উদ্যোগ সেই উৎকণ্ঠাকে আরও বেশি ঘনীভূত করে। সরকার জনস্বার্থকে আদৌ বিবেচনায় নিচ্ছে কি না সেই প্রশ্ন ওঠে।'

ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এতগুলো বিলাসবহুল গাড়ি কেনার অর্থ হলো জনগণের বোঝা বাড়ানো। তিনি বলেন, 'অর্থনীতিতে একটা সংকট চলছে। সামনে বাজেট আসছে। আর যেহেতু এটা আমদানিনির্ভর তাই এর প্রভাব রিজার্ভের ওপরেও পড়ার কথা।

'ভবিষ্যতে যদি অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় তাহলে এটা বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেটা প্রয়োজন সাপেক্ষে হতে হবে। ঢালাওভাবে হওয়া যাবে না। একজনকে দিলে সবাইকে দিতে হবে—এমন হলে হবে না। কারণ এটা কারও ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য না। পারিবারিক সম্পদের ব্যাপারও না যে একজনকে দিলে সব সন্তানকে দিতে হবে। এটা জনগণের অর্থ।'

এ ব্যাপারে আলী ইমাম মজুমদারের ভাষ্য, 'যেখানে রিপ্লেস করা প্রয়োজন সেখানে (গাড়ি) দেওয়া যেতে পারে। এর প্রয়োজনটা ঠিক করা হয় কনডেম (পরিত্যক্ত) ঘোষণার পর। এর কতগুলো প্রক্রিয়া আছে। এর সঙ্গে বিআরটিএসহ অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। তারাই ঠিক করে যে এগুলো মেরামত করাটা আর সাশ্রয়ী হবে না। তখন তারা সুপারিশ করে রিপ্লেস করার জন্য।'

এই সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মনে করেন, 'সরকারি কাজ করতে হলে যে কর্মকর্তাদের গাড়ি প্রয়োজন হয় সেটা তাদের দিতে হবে। তবে কী গাড়ি দেওয়া হবে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত।' তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে এটা ঠিক। কিন্তু এতে করে কোনো জরুরি কাজ কিন্তু বন্ধ নেই। আর তারা (ডিসি, ইউএনও) কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত।'

তবে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ডিসি, ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত কোনো সঠিক পদক্ষেপ নয় বলে মন্তব্য করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। বলেন, 'অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি আমি দেখছি না; বরং সংকট আরও গভীর হয়েছে। তাই আমি মনে করি না যে এটা কোনো সঠিক পদক্ষেপ। সরকার যখন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে তখন এগুলোকে অগ্রাধিকার তালিকার একেবারে তলানিতে রাখা উচিত।'

এই অর্থনীতিবিদের পর্যবেক্ষণ হলো, 'সরকার বলছে আগের বছরগুলোতে বাজেটের আকার যেভাবে বেড়েছে এবার সে হারে বাড়বে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও কাটছাঁট করার কথাবার্তা চলছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পরিকল্পনার ভেতর যদি এগুলো থেকেই থাকে তাহলে গাড়ি কেনার এই সিদ্ধান্ত কেন?'

অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বর্ণনায় সেলিম রায়হান বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হয়নি, রিজার্ভ ফল করছে, রাজস্ব আদায়ের অবস্থা ভালো না। যে এসইউভিগুলো কেনা হবে সেগুলো ডেফিনিটলি আমদানি করা হবে। তার মানে এখানে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে। এ অবস্থায় এতগুলো বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে?'

তার প্রস্তাব, 'এক্ষেত্রে বিকল্প সমাধান ভাবা যেতে পারে। যে গাড়িগুলো আছে সেগুলোকে মেরামত করে কাজ চালানো যেতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তখন নতুন গাড়ি কেনার কথা ভাবা যেতে পারে।'

চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসইউভি কেনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাবে অনুমোদন দেন।

এর আগে গত বছরের ১১ অক্টোবর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে এসইউভি কেনার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

পরে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রস্তাবটি অনুমোদন করে বলে জানা যায়।

এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান, গাড়িগুলো কেনা হবে ডিরেক্ট পারচেজ মেথড (ডিপিএম) অনুসরণ করে।

আরও জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসনের জন্য ৯৬টি ও উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৩৬৫টিসহ মোট ৪৬১টি এসইউভি কেনার প্রস্তাব করেছিল।

এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় গাড়ির সংখ্যা কমানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানায়। পরে ২৬১টি এসইউভি কেনার বিষয়ে একটি সংশোধিত প্রস্তাব পাঠানো হয়।

Comments