যেভাবে হয়েছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
সকাল থেকেই মেহেরপুর মহকুমার ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন প্রত্যন্ত ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে সাজ সাজ রব। গ্রীষ্মের রোদের প্রচণ্ড উত্তাপেও আমবাগানে অবশ্য ছায়া সুনিবিড়। আম গাছের ঘন পাতার বিস্তারে পরিপূর্ণ আকাশ না দেখা গেলেও পাতার মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রোদ। অজপাড়াগাঁয়ের এই আমবাগানে আজ যেন মানুষের মেলা বসেছে। উপস্থিত দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় নেতাকর্মী, ভারতীয় বাহিনীর কর্মকর্তা ও স্থানীয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। উপস্থিত সবার মাঝেই চাপা উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা।
ভারতীয় সীমান্তবর্তী অখ্যাত এই অজপাড়াগাঁয়ে একটু পরেই শুরু হবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান। এক সপ্তাহ আগেই যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়।
স্থানীয় ভবেরপাড়ার একটি মিশনারি হাসপাতাল থেকে আনা কিছু চেয়ার টেবিল জুড়ে দেয়া হয়েছে মঞ্চে। মঞ্চের একটি চেয়ার ফাঁকা। সে চেয়ারে রাখা হাতে আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে মঞ্চের পাশেই তৈরি করা হয়েছে দুটি তোরণ। একটু দূরেই অবস্থান নিয়েছে ভারতীয় বাহিনীর ৩০টিরও বেশি অ্যান্টি এয়ার ক্রাফট গান। পাশাপাশি অবস্থানে কয়েকটি ট্যাংক।
মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান যে কারণে বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে
১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পর ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথের দিন ধার্য করা হয়েছিল।
মন্ত্রিসভা গঠন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আসহাবুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। বিষয়টি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হলে পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপক বিমান হামলা ও আর্টিলারির মাধ্যমে গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এমতাবস্থায় ভারত সরকারের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ১৪ এপ্রিলের বদলে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে।
তখন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (পরবর্তীতে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানের কার্যক্রম ও রাজধানী চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে স্থানান্তর করেন।
পূর্বের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সম্পূর্ণ বিষয়টিই গোপন রাখা হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল শপথের বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেনেছিলেন ১৫ এপ্রিল রাতে। মন্ত্রিসভার তিন সদস্য ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী জেনেছিলেন ১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানে যাত্রার মাত্র ৩০ মিনিট আগে।
১৫ এপ্রিল মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরীকে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের জন্য ভারত সীমান্তবর্তী একটি নিরাপদ ও নির্জন স্থান বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত যাচাই বাছাইয়ের পর অখ্যাত পাড়াগাঁয়ের বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগান নির্বাচন করা হয়। আমবাগানটি নির্বাচনের কারণ ছিল বাগানের ওপর থেকে ঘন পাতার আচ্ছাদনের কারণে নিচে দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত এটি সীমান্তের খুব কাছে।
অন্যদিকে ১৫ এপ্রিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে চলে গিয়েছিলেন পাবনা জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের ও মাগুরা মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম। শপথ অনুষ্ঠানের বিষয়ে কতটা গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় নুরুল কাদের ও ওয়ালিউল ইসলামের টেলিফোন আলাপে।
১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে নুরুল কাদের ওয়ালিউল ইসলামকে বললেন, 'আগামীকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চলে আসো। কিছু কাজ আছে আমাদের।'
পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল সকাল ৮টায় নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তারা শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে পারেন দুজনে। তার পূর্ব পর্যন্ত তারা জানতেন একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা। ১৭ এপ্রিল সকাল ৮টায় নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফোনে তাদের বলেন, 'দেখুন আমাদের কাছে খবর এসেছে আমাদের জেলার কাছাকাছি বাংলাদেশের ভিতরে আপনাদের সরকার শপথ নিবে। আপনারা যারা এখানে আছেন তাদের সবাইকে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।'
অন্যদিকে ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় কলকাতা প্রেসক্লাবে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'পরদিন বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহীদের ভোরের মধ্যেই প্রেসক্লাবে উপস্থিত থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই তাদের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে।
যেভাবে হয়েছিল অনুষ্ঠানের আয়োজন
১৬ এপ্রিল সীমান্তে প্রতীকী নিরাপত্তার জন্য ইপিআর ও আনসারের একটি কন্টিনজেন্ট রাখেন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী। এসময় তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) স্থানীয় কর্মকর্তাদের কলকাতা থেকে সাংবাদিকদের আগমনের সংবাদ জানিয়ে বিএসএফ সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন, এদিন রাতেই বিএসএফ সদর দপ্তর থেকে স্থানীয় বিএসএফ ঘাঁটিকে নিরাপত্তা আয়োজনের নির্দেশনা দেয়া হয়। একইসঙ্গে ভারতীয় বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর আর্টিলারি বিভাগকেও পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা থেকে সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে সীমিত ও সংক্ষিপ্ত।
স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের তত্ত্বাবধানে ১৬ এপ্রিল রাতে তৈরি হয় একটি ছোট মঞ্চ। প্রথমে মাটির উপর চৌকি। কাপড়, বাঁশ ও দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে সাজানো হয় গেট। স্থানীয় মিশনারি হাসপাতাল থেকে চেয়ার-টেবিল আনা হলেও মাইক এসেছিল ভারত থেকে।
আমবাগানে কিছু হচ্ছে অনুমান করেছিল রাজাকাররা
বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে যে একটা কিছু হতে যাচ্ছে অনুমান করতে পেরেছিল রাজাকারেরা। কারণ শেষ রাত থেকেই ভারতীয় বাহিনীর বিমান আকাশে চক্কর দেয়। ভারতীয় সীমান্তে মোতায়েন করা হয় ট্যাংক ও অ্যান্টি এয়ার ক্রাফট। বিষয়টি টের পেয়ে রাজাকাররা মেহেরপুর ছেড়ে যায়। এর আগে তারা রটিয়ে দেয় আমবাগানে হিন্দুদের পূজা হবে। সে পূজায় যাওয়া মুসলমানের জন্য হারাম।
মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন
বেলা ১১টায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। প্রথমেই কলেজ ছাত্র বাকের আলী কোরআন তেলওয়াত পাঠ করেন। এরপর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় 'আমার সোনার বাংলা'। শপথ অনুষ্ঠানে কোরআন তেলওয়াত কে পাঠ করবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছিল সংকট। সকালে হিন্দুদের পূজার কথা শুনে কৌতূহলবশত কী হচ্ছে দেখতে এসেছিলেন বাকের আলী। অন্যদিকে স্থানীয় ইমাম, মুয়াজ্জিনরা সকালেই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় দেখা দিয়েছিল তেলওয়াতকারীর সংকট। প্রথমে বাকের তেলওয়াত করতে অস্বীকৃতি জানালে অধ্যাপক ইউসুফ আলী তাকে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন 'বাবা তুমি ভীষণ সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশের জন্মের অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াতের জন্য। তুমি আল্লাহ'র নাম করে তেলাওয়াত শুরু করো।'
কোরআন তেলওয়াতের পর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অতঃপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ।
গার্ড অব অনার
অনুষ্ঠানে সদ্য শপথ নেওয়া ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের গার্ড অব অনার দেয়ার দায়িত্ব ছিলো মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর কাঁধে। কিন্তু তখনো আবু ওসমান চৌধুরী শপথ অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে পারেননি। তখন তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী আবু ওসমান চৌধুরীর স্থলে ঝিনাইদহের পুলিশ প্রশাসক মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে গার্ড অব অনারের অনুরোধ করেন। এসময় মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বললেন, 'তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি একজন পুলিশ অফিসার, জীবনে বহুবার গার্ড অব অনার নিয়েছি, গার্ড অব অনার দিয়েছি। আমি এখনই ব্যবস্থা করছি।'
তিন-চারজন পুলিশ কনস্টবল ও কয়েকজন আনসার সদস্যকে ডেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে বুঝিয়ে দিয়ে প্রস্তুত করেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। পেছনে সরকারের প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। মঞ্চের বাঁ দিকে মাটিতে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। প্রেজেন্ট আর্মস করে যখন রাইফেল উর্ধ্বমুখী মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদান করেন হাত তুলে স্যালুট দেন। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।' এরপর মঞ্চের পাশেই পতাকা উত্তোলন করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি।
পতাকা উত্তোলন শেষে তিনি আবার মঞ্চে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত গাওয়া শেষ।
কমান্ড দিয়ে সালাম শেষ হলো। রাইফেলধারীদের অস্ত্র নেমে এল ঘাড়ে। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ হাত নামিয়ে কুইক মার্চ করে সামনে এগিয়ে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে বললেন, 'স্যার, আমাদের দল আপনার পরিদর্শনের অপেক্ষায়।'
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ধীর পদক্ষেপে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। এরপর তাকে সঙ্গে নিয়ে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন মাহবুব উদ্দিন। অবশেষে তিনি আবার মঞ্চে ফিরে যান।
প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ হয়েছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।
এদিন দুপুরেই আকাশবাণীতে সর্বপ্রথম শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের খবর প্রচারিত হয়। এরপর বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রসহ একাধারে রেডিওগুলো তা প্রচার করা হয়। পরদিন ভারতীয় সংবাদপত্রসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে শপথ অনুষ্ঠানের খবর প্রচারিত হয়।
সূত্র-
জীবনের জয়রথ (মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও কারাবাস)/ তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী
একাত্তরের রণাঙ্গন/ শামসুল হুদা চৌধুরী
মুজিবনগর সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ/ মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর ১৮ এপ্রিল ১৯৭১
Comments