যা দেখবেন আমঝুপি নীলকুঠিতে

বাংলার ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনের এক কলঙ্কিত অধ্যায় নীলচাষ। এই 'নীলচাষ' শব্দটি শুনলে এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসহায় কৃষকের মুখ, যার পিঠে চাবুক মারছে কোনো এক ইংরেজ সাহেব। এই ইতিহাস আজও অনেক নিদর্শনের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে আছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পুরোনো নীলকুঠিগুলোর মাধ্যমে।
তেমনি একটি অন্যতম প্রাচীন নীলকুঠি বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার আমঝুপি নীলকুঠি। এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, ইতিহাস, নিপীড়ন, প্রতিরোধ এবং বাংলার ঐতিহ্যের এক অনন্য সাক্ষ্য। আমঝুপি নীলকুঠিটি জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে, আমঝুপি ইউনিয়নের কাজলা নদীর তীরে অবস্থিত।
নীলকুঠি দর্শন
এই নীলকুঠি প্রায় ৭৭ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। এই নীলকুঠির মূল ভবনটিতে রয়েছে ১৫টি কক্ষ। এছাড়াও রয়েছে অতিথিশালা, বড় হল রুম, নৃত্যকক্ষ এবং ডাইনিং রুম। কক্ষগুলোতে এখনও দেখা যায় সেসময়ের কাঠের জানালা, পাথরের মেঝে, উচ্চ ছাদ এবং ইংরেজ আমলের আসবাবপত্রের অবশিষ্টাংশ।
নীলকুঠিতে প্রবেশের আগেই চোখে পড়বে বিশাল আমবাগান। আর আমবাগানের পার হলেই কুঠির প্রবেশের পথ। প্রবেশ পথের দুপাশে রয়েছে সুদৃশ্য ফুলের বাগান এবং পাথরের কারুকাজে সাজানো রাস্তা। মূল ভবনের চারপাশে বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর আর শতবর্ষী গাছগাছালি এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে। বিশেষ করে ভবনের পিছনের তালগাছগুলো। পরিষ্কার শুভ্র নীল আকাশের সঙ্গে সুউচ্চ তালগাছের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

কাজলা নদী
নীল চাষ, নীল গাছ থেকে নীল রং তৈরি এবং এর প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই নদীর তীরেই সাধারণত নীল কারখনা বা কুঠি গড়ে উঠত। আমঝুপি নীলকুঠিও এর ব্যাতিক্রম নয়। নীলকুঠিটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাজলা নদী। আজও এই নদী কুঠিটির সৌন্দর্য ও পরিবেশে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু নদীটির যৌবন এখন আর আগের মতো নেই। তবে বর্ষায় কাজলা নদী এবং নদীঘেঁষা বাঁধানো ঘাট দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
নীল গাছের দেখা
আমঝুপি নীলকুঠিতে এখনও নীল গাছের দেখা মেলে। এগুলো রয়েছে ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। গবেষকদের মতে, এই অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছিল এমন এক ধরনের নীল গাছ থেকে রং সংগ্রহ করে রপ্তানি করা হতো ইউরোপে। সেই নীল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যই স্থাপন করা হয়েছিল এই কুঠিবাড়ি।

নীলকুঠি নিয়ে জনশ্রুতি
আমঝুপি নীলকুঠি নিয়ে কথিত রয়েছে যে, পলাশী যুদ্ধের আগে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মীর জাফরসহ ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে রবার্ট ক্লাইভের শেষ বৈঠক বসেছিল এই নীলকুঠিতে। তাই এ অঞ্চলের অনেকেই মনে করেন এই বৈঠকটি না হলে স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হতো না। যদিও এ বিষয়ে অকাট্য কোনো প্রমাণ নেই, তবুও স্থানীয়রা এ নিয়ে নানা গল্প বলেন, যা এই নীলকুঠিকে আরও রহস্যময় ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
সব মিলিয়ে আমঝুপি নীলকুঠি একটি অতুলনীয় দর্শনীয় স্থান। যারা ইতিহাস-ঐতিহ্য ভালোবাসেন, তাদের জন্য আমঝুপি নীলকুঠি হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য।

দর্শনের সময় ও টিকিট মূল্য
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে এটি প্রথম সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এটি সংরক্ষিত ও পরিচর্যা করা হয়। মাত্র ২০ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়ে আমঝুপি নীলকুঠিতে প্রবেশ করা যায়। দর্শনার্থীরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে ঘুরে দেখতে পারেন।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেনে আসতে চাইলে ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলওয়ে স্টেশনে নামতে হবে। এরপর সিএনজি বা অটোরিকশায় সরাসরি নীলকুঠি আসা যায়। আসার আগেই ট্রেনের সময়সূচি সম্পর্কে জেনে নেওয়া ভালো।
এছাড়া ঢাকার কল্যাণপুর ও সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে মেহেরপুর সদরে নিয়মিত বাস চলাচল করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বাস হলো এসবি, জে আর, শ্যামলী, আর কে ইত্যাদি। এসি-নন এসিভেদে এসব বাসের ভাড়া ৬৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
এরপর মেহেরপুর শহর থেকে বাস, অটো কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় খুব সহজেই আমঝুপি নীলকুঠিতে পৌঁছানো যায়। ভাড়া ও সময় স্থানীয় যানবাহনের ওপর নির্ভর করে। তবে এখানকার রাস্তাঘাট বর্তমানে বেশ উন্নত। পাশাপাশি যাত্রাপথে দেখা মেলে গ্রামীণ প্রকৃতি—সবুজ ধানখেত, কাঁচা রাস্তা, নদী এবং পাখির কলরব।
যেখানে থাকবেন
মেহেরপুরে থাকার জন্য উন্নত মানের আবাসিক হোটেল না থাকলেও চলনসই মানের কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া সার্কিট হাউজসহ জেলা পরিষদ ডাক বাংলো ও সূর্যোদয় ডাক বাংলো রয়েছে। যেগুলোয় ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় রাতযাপন করা যায়। তবে এটি যেহেতু এখনো ব্যাপক পর্যটন সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেনি, তাই নিজস্ব খাবার ও পানীয় সঙ্গে নেওয়াই ভালো।
Comments