নাটোরে ‘সন্ত্রাসীদের ভয়ে’ টেন্ডার বিক্রি বন্ধ
নাটোর সদর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ ভবন মেরামত ও সংরক্ষণ কাজের শিডিউল কিনতে পারেননি ঠিকাদাররা।
বেশ কয়েকজন তালিকাভুক্ত ঠিকাদার শিডিউল কিনতে গিয়েও ফিরে এসেছেন।
অফিস থেকে তাদের জানানো হয়েছে, শিডিউল শুধু নির্ধারিত ঠিকাদাররাই কিনতে পারবে। অন্য কারও কাছে বিক্রি করা যাবে না।
ঠিকাদাররা বলছেন, নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা রাশিদুল ইসলাম কোয়েলের ভয়ে টেন্ডার শিডিউল বিক্রি করছে না উপজেলা প্রকৌশল অফিস।
ইজিপি পদ্ধতিতে টেন্ডার না দিয়ে তড়িঘড়ি করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টেন্ডার আহ্বান করায় এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এমন সমস্যা তৈরির সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ঠিকাদার ও জনপ্রতিনিধিরা।
সদর উপজেলা পরিষদের পরিচালন বাজেটে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থবছরে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ছাতনী বাদে ৬টি ইউনিয়নের জন্য মোট ৫৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে, তেবাড়িয়া ইউনিয়নের জন্য ৯ লাখ, দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের জন্য ৯ লাখ ৯০ হাজার, লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের জন্য ৯ লাখ ৯০ হাজার, বড় হরিশপুর ইউনিয়নের জন্য ৮ লাখ ৬০ হাজার, কাফুরিয়া ইউনিয়নের জন্য ১০ লাখ এবং হালসা ইউনিয়নের জন্য ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
সম্প্রতি উপজেলা থেকে এসব ইউপি ভবন সংস্কার কাজের শিডিউল ছাড়া হলেও, বিক্রির পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা।
সরেজমিনে নাটোর সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের ভেতরে বসে আছেন কয়েকজন। কেউ শিডিউল নিতে এলে বলা হচ্ছে শিডিউল বিক্রি বন্ধ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাটোর সদর উপজেলা পরিষদে প্রকৌশল অফিসে বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুইদিনে কোনো শিডিউল বিক্রি হয়নি।
তবে নলডাঙ্গা উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে তিন সেট (১৮টি) এবং এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে তিন সেট (১৮টি) দরপত্র কিনেছেন নির্ধারিত ঠিকাদাররা।
স্থানীয় ঠিকাদার কামাল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিডিউল কিনতে গিয়ে নাটোর সদর উপজেলা প্রকৌশল অফিস থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পরে ফোন করে খোঁজ নিলে অফিস থেকে জানানো হয়েছে শিডিউল বিক্রি হবে না।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ঠিকাদার বলেন, 'সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলার শিডিউল নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে কিনেছি। কিন্তু সদর উপজেলার কোনো শিডিউল বিক্রি করেনি।'
আগামী রোববার পর্যন্ত শিডিউল বিক্রির সময় আছে বলে জানান তিনি। সুযোগ পেলে কেনার চেষ্টাও করবেন।
জানতে চাইলে নাটোর সদর উপজেলা প্রকৌশলী মো. বাকী বিল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিছু লোকজন এসে আমার অফিসের স্টাফদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে এবং শিডিউল বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। সে কারণে আমরা কোনো শিডিউল বিক্রি করছি না।'
'বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানিয়েছি। তিনি পুলিশকে চিঠি দিতে বলেছেন। আমরা চিঠি দেব,' বলেন তিনি।
ম্যানুয়াল টেন্ডার কেন দিলেন, জানতে চাইলে ওই প্রকৌশলী বলেন, 'শেষ সময়ে বরাদ্দ পেয়েছি। এখন অনলাইনে টেন্ডার আহ্বান করার মতো সময় নাই। তাই অফলাইনে শিডিউল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'
অফলাইনে শিডিউল বিক্রি নিয়মের বরখেলাপ কি না, জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. বাকী বিল্লাহ বলেন, 'শুধু আমরা এই পদ্ধতিতে টেন্ডার দিয়েছি এমন নয়। সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলাতেও একই পদ্ধতিতে টেন্ডার দিয়েছে। অনিয়ম হলে তো তারাও করছে।'
জানতে চাইলে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. বদিউজ্জামান বলেন, 'ছয়টি ইউনিয়নের তিন সেট করে ১৮ সেট শিডিউল উপজেলা অফিস থেকে বুধবার দিয়ে গেছে। শিডিউল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের কয়েকজন অনুসারী মিম ট্রেডার্স ও মুক্তার ট্রেডার্সের নামে কিনে নিয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'পরে আর কোনো শিডিউল সেট উপজেলা থেকে দিয়ে যায়নি এবং ফটোকপি করে বিক্রি করতেও নিষেধ করেছেন। নলডাঙ্গা উপজেলা প্রকৌশল অফিসেও একইভাবে দিয়েছে।'
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে নাটোর সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শরিফুল ইসলাম রমজানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যুবলীগ নেতা রাশিদুল ইসলাম কোয়েল ও তার লোকজন টেন্ডার কিনতে ঠিকাদারদের বাধা দিচ্ছে বলে শুনেছি। তাদের উপজেলা পরিষদ চত্বরে দেখতে পেয়ে আমি তাদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি।'
টেন্ডার কিনতে ঠিকাদারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাশিদুল ইসলাম কোয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমিও ঠিকাদার। আমি নিজেই কাজের জন্য শিডিউল কিনেছি। কাউকে শিডিউল কিনতে বাধা দেইনি। আমার বিরুদ্ধে এসব ভুয়া কথা বলেছে। শুনেছি আরও দুয়েকদিন শিডিউল কেনার সময় আছে। যারা কিনতে পারেনি, তাদের এখনো সুযোগ আছে।'
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নাটোর জেলা কমিটির সভাপতি খগেন্দ্রনাথ রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম বন্ধে ই-টেন্ডার চালু করেছে। সেখানে এভাবে অফলাইনে টেন্ডার দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না। এটা সরকারি টাকা আত্মসাতের একটা দুরভিসন্ধি মনে হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে শিডিউল যদি বিক্রি করা না যায় তাহলে পুলিশের সহযোগিতা কেন নেওয়া হয়নি। এতে ধারণা করা যায়, অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। এটা তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দেশ যখন আর্থিকভাবে হিমশিম খাচ্ছে তখন এসব লুটপাট কঠোর হাতে দমন করতে হবে।'
যোগাযোগ করা হলে নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপজেলা প্রকৌশল অফিসে শিডিউল বিক্রিতে সন্ত্রাসীরা বাঁধা দিচ্ছে, এমন খবর পেয়ে বিকেল ৩টার দিকে সেখানে গিয়ে তেমন কোনো আলামত পাইনি।'
'উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস বন্ধ ছিল। পরে কর্মকর্তা এলে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন যে, কোনো সমস্যা নাই। পরে আমরা ফিরে আসি,' বলেন ওসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী বলেন, 'পুলিশ আসার পর দুর্বৃত্তরা সরে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর কোনো ঠিকাদার শিডিউল নিতে আসেনি। রোববার ও সোমবার পর্যন্ত সময় আছে কেউ কিনতে চাইলে হয়ত কিনতে পারবে। শিডিউল বিক্রির সময় ও জমা দেওয়ার সময় পুলিশ চেয়ে চিঠি দিয়েছি।'
Comments