ঢাকার জলাবদ্ধতা আর কতদিন

গত চার বছরে ডিএনসিসি ব্যয় করেছে ৩৭০ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসি ব্যয় করেছে ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শান্তিনগরের মতো এলাকা, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা, সেখানে এখনো তীব্র জলাবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে।
ছবি: স্টার

গত চার বছরে অসংখ্য উদ্যোগ ও ৭৩০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা সত্ত্বেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।

গত শুক্রবারের প্রবল বৃষ্টিপাতে রাজধানীর অন্তত ২২টি এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে নগরবাসী ও যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এমনকি ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন ছিল।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন।

চার বছর এবং ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কার্যকর পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুর্বল নকশা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং রাস্তা নির্মাণের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে।'

'প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা জানান, তহবিলের অর্থ খাল, ড্রেন ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার এবং জমে থাকা বর্জ্য অপসারণে ব্যবহার করা হয়।

তবে তারা স্বীকার করেন, পরিষ্কার করার কয়েকদিন পর খালগুলো দ্রুত আবার ময়লা জমে আটকে যায়।

গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। যার ফলে শহর জুড়ে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল এবং কার্জন হলের মতো এলাকা; স্বামীবাগ; বকশী বাজার; খাজে দেওয়ান; মুগদা; মানিকনগর; গোপীবাগ; লালবাগ এবং বুয়েট ক্যাম্পাস শনিবার পর্যন্ত জলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল।

বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের আরও কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

মজিবুর রহমান অব্যাহত জলাবদ্ধতার জন্য জলাশয়, খাল ও হ্রদ ভরাট করার পাশাপাশি দুর্বল ড্রেনেজ নেটওয়ার্ককে দায়ী করেছেন।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য আরও তীব্র বৃষ্টিপাত হবে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে।

সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, জনবল বাড়াতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।

'খাল এবং জলাশয় পুনরুদ্ধার করতে এবং একটি প্রাথমিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান প্রয়োজন।'

ঢাকায় বর্তমানে দুই হাজার ২১১ কিলোমিটার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার ৯৬১ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং এক হাজার ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে। সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নেওয়ার আগে জলাবদ্ধতা রোধে প্রাথমিকভাবে নজর ছিল খোলা ড্রেন।

এখন করপোরেশনগুলো খাল ও ড্রেনগুলোর জন্যও দায়ী, যার জন্য যথেষ্ট আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন৷

গত চার বছরে ডিএনসিসি ব্যয় করেছে ৩৭০ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসি ব্যয় করেছে ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শান্তিনগরের মতো এলাকা, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা, সেখানে এখনো তীব্র জলাবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাল সময়ের ব্যবধানে দখল ও সংকুচিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় ৫৭টি খাল থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬টিতে, যার অধিকাংশই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ড্রেনে বর্জ্য জমার কারণে কিছু এলাকায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে, যারা খাল-নালায় বর্জ্য ফেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, পানি নিষ্কাশনে দুর্বলতার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে নগরবাসীর অভ্যাসগতভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও এই সমস্যায় অবদান রাখছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ঢাকা গত ২০ বছরে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাশয় হারিয়েছে।

বিআইপির সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তনের অভাব জলাবদ্ধতার একটি বড় কারণ।

তিনি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগে জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নিম্নাঞ্চল দখলকারী আবাসন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন।

তিনি এ সমস্যা সমাধানে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানান এবং প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন করার জন্য সিটি করপোরেশনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।

অন্য একটি পরিবেশ সংগঠন 'ধরিত্রী রক্ষায় আমরা'র সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, জলাবদ্ধতার পেছনে যৌক্তিক কারণ চিহ্নিত না করে অর্থ ব্যয় করলে অর্থের অপচয় হয়। কোনো প্রকল্পই প্রকৃতির গুরুত্ব বিবেচনা না করে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করতে পারে না।

'প্রকল্পগুলো যদি সমস্যার সমাধান না করে, তাহলে করপোরেশনগুলোর উচিত তাদের ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করা।'

Comments