৯ বছরে ৭০৭ কোটি টাকা খরচ, তবুও ডেঙ্গুর প্রকোপ ঢাকায়

গত ৯ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে খরচ করেছে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা। তারপরও এই শহরের বাসিন্দাদের মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচানো যায়নি।

এই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কীটনাশক, আগাছা ও জলাশয় পরিষ্কার এবং যন্ত্রপাতি কিনতে প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা খরচ করেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এ বাবদ খরচ করেছে প্রায় ২৪৩ কোটি টাকা।

এ বছর ডিএনসিসি মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য ১৩৫ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসি ৪৬ কোটি ৫০ টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে।

তারপরও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রাজধানীর নিয়মিত চিত্র।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরনো কৌশল, দুর্বল পরিকল্পনা ও সার্বিক নীতির অভাবে সিটি করপোরেশনগুলোর মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কার্যকর হয়নি।

তারা সতর্ক করে বলেন, জাতীয় পর্যায়ে মনিটরিংয়ের সহায়তায় সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই ব্যর্থই থাকবে। তাই বছরের পর বছর একই পুরনো পদ্ধতি ব্যবহারের অবসান করতে হবে।

তারা কার্যকর জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে একটি বিশেষায়িত সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন।

সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা যখন কৌশল ও অর্থায়ন নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত, তখন বাসিন্দাদের কপালে রয়ে গেছে সেই ভোগান্তিই। প্রতিবার বৃষ্টির পর মহল্লাগুলোতে তৈরি হয় শঙ্কা। সব ধরনের সতর্কতা মেনেও আক্রান্ত হচ্ছে পরিবারগুলো।

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত মিরপুরের বাসিন্দা আসাদ রহমানের কথাই ধরা যাক। তিনি মশারি, স্প্রে, কয়েল, রিপেলেন্ট কিনে এবং নিয়মিত বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেছেন। তারপরও সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি, তার স্ত্রী ও তার বৃদ্ধা মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা সম্ভাব্য সব করেছি। এমনকি সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করেছি।'

আসাদ বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা দেখিনি। আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝে ফগিং হয়। এ ছাড়া, আর কিছুই চোখে পড়েনি।'

তিনি আরও বলেন, 'মনে হয় আমরা একাই লড়ছি।'

২০০০ সালে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ডেঙ্গুকে একসময় মৌসুমি সমস্যা বলে মনে করা হতো। কিন্তু, এখন তা বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বছরই মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন, আর আক্রান্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৬০ জন।

পরিস্থিতি ভয়াবহ হয় ২০১৯ সালে। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৯ ছাড়ায়। তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০২৩ সালে। সে বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যায় এবং ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১০৫ জন—এর মধ্যে ৪৫ জন ঢাকায়। গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩৮০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৭৫৮ জনে—যার মধ্যে ৬ হাজার ১৩৩ জন ঢাকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক ডেঙ্গু বুলেটিনে ঢাকার মাত্র ৫৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ৮০টি জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালের তথ্য থাকে। অথচ সারা দেশে প্রায় ১৬ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়। এর অর্থ, প্রাদুর্ভাবের প্রকৃত চিত্র এখনো অজানা।

সেই একই পদ্ধতি

প্রতি বছর ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায়, যার উদ্দেশ্য ডেঙ্গু ও অন্যান্য বাহকবাহিত রোগের বিস্তার ঠেকানো।

এসব কার্যক্রমের মধ্যে সাধারণত থাকে—আবাসিক এলাকা, বাজার ও জনসমাগমস্থলে পূর্ণবয়স্ক মশা মারতে ফগিং; জলাশয়, নালা-নর্দমা ও নির্মাণস্থলে লার্ভিসাইড স্প্রে। এছাড়া তারা সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও বিশেষ অভিযানও চালানো হয়।

আর সিটি করপোরেশনগুলোর ব্যয়ের সিংহভাগই যায় কীটনাশক কেনায়।

উদাহরণস্বরূপ, ডিএনসিসি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ১৩৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে কীটনাশক কেনার জন্য। গত অর্থবছরে তারা কীটনাশকেই খরচ করেছে ৬৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ডিএসসিসি মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে কীটনাশক কেনার জন্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে বাজেট ছিল ৪০ কোটি টাকা।

বাকি অর্থ সাধারণত ব্যয় হয় সরঞ্জামে—যেমন: ফগার মেশিন, চাকা, স্প্রে মেশিন, সেগুলো পরিবহন এবং বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই পুরনো পদ্ধতিতে মশার উপদ্রব কমানো সম্ভব নয়।

কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনগুলোকে বছরের শুরু থেকেই প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে প্রথমে ডেঙ্গু রোগীর ভিত্তিতে মহল্লাগুলো ভাগ করতে হবে, এরপর সেখানে জোরালো মশকনিধন অভিযান চালাতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, 'মাঠপর্যায়ের কাজ নিয়মিত মূল্যায়ন করতে হবে, অন্তত প্রতি দুই মাস পরপর। মনিটরিং রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা শহরভেদে ভিন্ন হয় এবং সেই অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। আমরা একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করে যাচ্ছি। অথচ মশা সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছে।'

'গবেষকদেরও আমরা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পারিনি। সরকারকে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে এবং ল্যাবরেটরির ফলাফল ব্যবহার করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

করণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা বিভাগ ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এই বিভাগ ভেক্টর নিয়ে গবেষণা ও সেগুলো নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা তৈরি করবে। তাদের গবেষণা ফলাফল ও পরিকল্পনা দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো হবে এবং বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাইফুর রহমান বলেন, 'ভেক্টর ব্যবস্থাপনায় জাতীয় পর্যায়ে বিশেষায়িত কর্তৃপক্ষ না থাকায় মশা নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন একা এই কাজ করতে পারবে না। কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে একটি বিশেষায়িত সরকারি বিভাগ থাকা উচিত, যারা সারাদেশে নজরদারি রাখবে, তথ্য বিশ্লেষণ করবে, নির্দেশনা দেবে এবং কার্যক্রমের সমন্বয় করবে।'

তিনি বলেন, 'এই বিভাগে বহুমুখী বিশেষজ্ঞ দল থাকবেন। যেমন: বায়োকেমিস্ট, জীববিজ্ঞানী, সেরোলজিস্ট ও জিআইএস বিশেষজ্ঞরা। তারা সারা বছর কাজ করবেন প্রতিরোধ ক্ষমতার ধরন শনাক্ত করতে এবং কীটনাশক ব্যবহারের দিকনির্দেশনা দিতে।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা এখনো জানি না যে, কোন কীটনাশক বর্তমানে এডিস মশার বিরুদ্ধে কার্যকর।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ফারহাদ হোসেন জানান, তারা ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে এবং ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে অন্যান্য কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, 'দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সব কেন্দ্রকে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'

দুই সিটি করপোরেশনের বক্তব্য

কীটনাশক কার্যকর কি না—জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, 'আমরা কীটনাশক তখনই ব্যবহার করি, যখন তিনটি আলাদা পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। এই পরীক্ষাগুলো করে আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখা এবং ডিএসসিসি।'

তিনি বলেন, 'মাঠপর্যায়ে সমন্বিত পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা কীটনাশক ব্যবহার করি।'

এখন পর্যন্ত কীটনাশকে মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।

ফগিং অনিয়মিত হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে নিশাত বলেন, তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া রোগীর তালিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকায় ফগিং করেন।

যোগাযোগ করা হলে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিংয়ের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক কার্যকর। এগুলো কেনার আগে তিনটি পরীক্ষার পাশাপাশি তারা প্রতিদিন এডিস লার্ভা সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষা চালান।

তবে এজাজ বলেন, মূল সমস্যা মাঠকর্মীদের নিয়ে। তাদের অনেকেই আগে সঠিকভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করেননি। আরেকটি সমস্যা হলো, বাড়ির ভেতরে অভিযান চালাতে না পারা। বাড়ির ভেতরে মশার প্রজননস্থল থেকে যায় এবং সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়ায়।

তবে, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং ডিএনসিসি এলাকার বাড়িগুলোতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

With acreage and output falling, is there any prospect for wheat in Bangladesh?

Falling wheat acreage raises questions about food security amid climate change

15h ago