গুলি-ছররা গুলিবিদ্ধদের চাপে ঢাকার হাসপাতালগুলো

ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলি-ছররা গুলিতে আহত রোগীদের কয়েকজন। ছবি: স্টার

তাদের কেউ কিশোর, কারো বয়স ২০ এর মধ্যে, কেউবা মধ্যবয়সী। কিন্তু, একটি জায়গায় সবাই এক—প্রত্যেকেই গুলিবিদ্ধ। কেউ ছররা গুলি, আবার কেউ গুলিতে আহত। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে আহত হন তারা।

তাদের অনেকেই দাবি করেছেন, এই সহিংসতা বা বিক্ষোভের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

আহতদের ভাষ্য, তারা ছিলেন সাধারণ পথচারী কিংবা বিভিন্ন জরুরি কাজে বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হওয়া মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন তারা হাসপাতালের বিছানায়।

গত বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকার হাসপাতালগুলো—প্রধানত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল—গুলি ও ছররা গুলির আঘাতে আহত রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

শফিকুল ইসলামের কথাই ধরুন।

রোববার সন্ধ্যায় বাইরের পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে পিঠে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার ঢামেক হাসপাতালে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে শফিকুলের পাশে ঘুমিয়ে আছে তার চার বছরের মেয়ে ফাতেমা।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শফিকুলের পিঠে বিদ্ধ হওয়া বুলেট বের করা হয়।

তিনি বলেন, 'শরীর নড়াতে পারি না। কখনো কখনো এত ব্যথা হয়, মনে হয় যেন মরে গেলেই ভালো ছিল। আর মনে হয় কোনো দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না।'

বর্তমানে গুলি ও ছররা গুলিতে আহত অন্তত ২১৭ জন রোগী ঢামেকে চিকিৎসাধীন।

ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ধারালো ধারালো অস্ত্র, ছররা গুলি ও গুলির আঘাতে আহত প্রায় এক হাজার ৭১ জন রোগী ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এই সময়ে অন্তত ৬০ জনের মরদেহ আনা হয়েছে এবং ১৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বলে জানান তিনি।

মিরাজ হোসেনও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢামেকে ভর্তি হন।

তিনি সকালের নাস্তা করতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। রামপুরার বউবাজারে পৌঁছলে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি। সবাই দৌড়াচ্ছিল। কিছু বোঝার আগেই একটি বুলেট তার বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে যায়।

জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখতে পান, ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসকরা তার রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার শরীরে বিদ্ধ গুলি বের করা হয়। শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল হলেও তিনি খেতে পারছেন না এবং শরীরে লাগানো পাইপের মাধ্যমে টয়লেট করতে হচ্ছে।

নিউমার্কেট এলাকার মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী মো. সুমনও জানান একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা।

তার কোমরের নিচে গুলি লেগেছে।

সুমন বলেন, 'আমি আজিমপুরে থাকি। শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য বের হয়েছিলাম। নিউমার্কেট এলাকায় পৌঁছালে হঠাৎ একটা বুলেট আমার গায়ে লাগে। ডাক্তাররা জীবন তো বাঁচিয়ে দিলো, কিন্তু কোনো দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না মনে হয়। আর কোনোদিন হাঁটতে পারব কি না, জানি না।'

নরসিংদীতে নানার বাড়ি বেড়াতে যাওয়াটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে ১৭ বছর বয়সী মো. সিফাতের জন্য। সেখানে বাইরে ঘুরতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

গুলি তার কোমর লেগেছে। তার কব্জিতে একটি ক্যানুলা, আর সারা শরীরে পাইপ লাগানো হয়েছে।

কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না সিফাত। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রু।

তার খালা নাসরিন আক্তার বলেন, 'সিফাত খুব ভালো ছেলে। সে কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়ায়নি। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শরীয়তপুর থেকে সে তার নরসিংদীতে বেড়াতে আসে।'

নাসরিন বলেন, 'সিফাত এখন শক্ত খাবার খেতে পারছে না। পাইপের মাধ্যমে তাকে শুধু তরল খাবার দেওয়া হচ্ছে।'

১৬ বছর বয়সী ওয়ালিউল্লাহ পাঁচ জনের পরিবারের মেঝ সন্তান।

দারিদ্র্যের কারণে তাকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য ছিল না বাবা-মায়ের।

পরিবার চালাতে বাবাকে সাহায্য করার জন্য নরসিংদীতে একটি দোকানে কাজ করতেন ওয়ালিউল্লাহ। শুক্রবার দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে গেলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার অবস্থাও সিফাতের মতো।

শুক্রবার গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজ পেয়ে সারাদিন বাড়ি থেকে বের হননি মো. রুবেল। কিন্তু খাবার পানি শেষ হয়ে গেলে পানি কিনতে বের হন তিনি। মুগদা বিশ্বরোডে যাওয়ার পর একটি গুলি তার পিঠে বিদ্ধ হয়।

ঢামেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আলাউদ্দিন জানান, এখন যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাদের সবাইকে গুরুতর অবস্থায় আনা হয়েছিল। সবারই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, 'তাদের বেশিরভাগের অবস্থা এখন স্থিতিশীল হলেও ক্ষত স্থানে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।'

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি, অর্থোপেডিক অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন এবং সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই অবস্থা।

অর্থোপেডিক অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন হাসপাতাল ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৩৬৯ রোগীকে চিকিত্সা দিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই গুলি ও ছররা গুলিতে আহত ছিলেন বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান।

আহতদের মধ্যে ৫৩৭ জন এখানে ভর্তি হয়েছেন।

এই পাঁচ দিনের মধ্যে শুক্রবার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ছিল বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।

তিনি বলেন, 'আমাদের সব ডাক্তার ও কর্মীদের সব ছুটি বাতিল করতে হয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছেন এবং আমাদের আটটি অপারেশন থিয়েটার ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখতে হয়েছে।'

জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা বলেছেন, সংঘর্ষ শুরু আগে সেসব রোগী ভর্তি ছিলেন তাদেরকে আগেই রিলিজ দিয়ে দিতে হয়েছে। তা না হলে গুলিবিদ্ধ এত রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হতো না।

এই হাসপাতালে গত ৯ জুলাই অস্ত্রোপচার হয় নাঈম মিয়ার (১৯)।

নাঈমের বাবা নাসের মিয়া জানান, তার ছেলের আরও অন্তত এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ১৯ জুলাই ডাক্তাররা তার ছেলে রিলিজ দিয়ে দেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আসতে বলেন।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক শফিউর রহমান জানান, এই সংঘর্ষে আহত ৫১৮ জন রোগীর চিকিত্সা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালটিতে।

তাদের মধ্যে ৩০ জনের বড় এবং ১৫০ জনের ছোট অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে জাতীয় চক্ষুবিদ্যা ইনস্টিটিউটে অন্তত ৩৯৪ জন রোগীর চিকিত্সা দেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের চোখে গুলি ও ছররা গুলি লেগেছে।

তাদের মধ্যে ১৫৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

Comments

The Daily Star  | English
Health Sector Reform Commission submits report to Yunus

Reform commission for universal primary healthcare

Also recommends permanent independent commission to govern heath sector

3h ago