শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান শামীম ওসমান ও তার বাহিনী, প্রকাশ হলো ভিডিও

নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধুর সড়কের পাশে কোনো উঁচু ভবন থেকে ধারণ করা এই ভিডিওতে শামীম ওসমানের বাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
নারায়ণগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমানের দুই পাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে দুই জন। সেখান থেকে তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। ছবি: ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী।

গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনীর অগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করার একটি ভিডিওচিত্র দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। ইতোমধ্যে ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধুর সড়কের পাশে কোনো উঁচু ভবন থেকে ধারণ করা এই ভিডিওতে শামীম ওসমানের বাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ভিডিওতে শামীম ওসমানের শ্যালক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটুকে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। দুটি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিলেন ডিবিসি টেলিভিশন ও যুগান্তর পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদ। আরও ছিলেন শামীম ওসমানের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) ফয়েজউদ্দিন লাভলু, লাভলুর ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ভিকি, শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুচর ব্যবসায়ী অনুপ কুমার সাহা, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনুও।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র হাতে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। ভিডিওতে দেখা না গেলেও ওই সময় শামীম ওসমান, তার ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ও তার ছেলে এমআরকে রিয়েনও গুলি চালিয়েছেন।

দেশ রূপান্তর পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি কমল খানকেও অস্ত্রের মহড়ায় দেখা যায়৷ গুলি করেন শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও৷

হামলায় আরও ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসমাইল রাফেল প্রধান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সম্রাট, সাধারণ সম্পাদক রাসেল প্রধানও। তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সেদিন রাইফেলস ক্লাব থেকে বেশকিছু আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির দখল ছিল শামীম ওসমানের হাতে। বাকি অস্ত্রগুলোর জোগান দেন শামীম ওসমানের শ্যালক ও বিসিবির পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটু। তানভীর আহমেদ টিটু নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং অভিজাতদের ক্লাব নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সাবেক সভাপতি।

১৯ জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে গুলি চালানোর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। তারা জানান, সেদিনে পরিস্থিতি ছিল ভীতিকর। ওই পরিস্থিতিতে ছবি ও ভিডিও ধারণের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক মারধরেরও শিকার হন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাঢ়া থেকে মন্ডলপাড়া মোড় পর্যন্ত শামীম ওসমান ও তার বাহিনী কয়েক দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এই সময় শতাধিক গাড়ির বহর ব্যবহার করেন তারা। তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের জালকুড়ি এলাকাতেও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়েন।

জালকুড়িতে গুলি করার একটি ভিডিও দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। ভিডিওটি কয়েকদিন আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ছেন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সঙ্গে ছিলেন শামীম ওসমান নিজেও।

রিয়া গোপের মৃত্যু নিয়ে নতুন তথ্য

এদিকে, ১৯ জুলাই দুপুরে যখন শামীম ওসমান তার বাহিনী নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি ছোড়েন তখন বঙ্গবন্ধু সড়কের নয়ামাটি এলাকার চারতলা ভবনের ছাদে খেলছিল ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপ। রিয়ার বাবা ব্যবসায়ী দীপক কুমার গোপ সাংবাদিকদের তখন জানিয়েছিলেন, 'গুলির শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে যান। ছাদ থেকে শিশু কন্যাকে কোলে নেওয়ার পরই রিয়ার মাথার পেছনের দিকে একটি গুলি লাগে। রক্তে ভেসে যায় দীপক কুমারের হাত।'

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ২৪ জুলাই হাসপাতালে মারা যায় রিয়া।

বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলি করার ভিডিওটি নিজের ফেসবুক একাউন্টে শেয়ার করেছেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বিও। ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, '১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরে শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর অস্ত্রসন্ত্রাস।'

২০১৩ সালে রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে রফিউর রাব্বিকে দমাতে তার ছেলেকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ ত্বকীর পরিবারের। দীর্ঘ ১১ বছরেও ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি।

যোগাযোগ করা হলে রফিউর রাব্বি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ১৯ জুলাই শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলিতেই শিশু রিয়া গোপ নিহত হয়।

তিনি বলেন, 'ঘটনার দিন ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে ছিল না। তখন শামীম ওসমান তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অসংখ্য গুলি ছুড়েন। প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ার বিষয়টি থেকে বোঝা যায়, শামীম ওসমানদের গুলিতেই রিয়া গোপ মারা গেছে।'

এই বিষয়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান তিনি।

যোগাযোগ করা হলে জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯ জুলাই দুপুরে যে সময় রিয়া গোপ গুলিবিদ্ধ হয়েছে তখন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না। তখন আন্দোলনকারী ও শামীম ওসমানের লোকজনের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়ই তখন ঘটেনি।'

ওইদিন দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আমীর খসরু। তিনি বলেন, 'কীভাবে এবং কাদের গুলিতে রিয়া গোপ মারা গেছেন সেই বিষয়ে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল।'

Comments