‘প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

'প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে' বলে নিজেদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিশন তাদের প্রতিবেদনে দুর্নীতি প্রতিরোধে তিনটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, 'প্রশাসনের রাজনীতিকরণের কারণে জনপ্রশাসনে মেধা ও দক্ষতার গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পেয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও দক্ষতার স্থান নিয়েছে দলীয় আনুগত্য ও চাটুকারিতা।'

'কেন্দ্রীভূত ও অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে জনপ্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা অনুচিত পদোন্নতি ও সুবিধা পেয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার পরিচালনার দোসরে পরিণত হয়েছিলেন' বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনে দুর্নীতি প্রতিরোধে তিনটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে কমিশন।

এর মধ্যে রয়েছে—মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সব জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব প্রতি বছর দিতে হবে এবং সেগুলো অনলাইনে প্রদর্শন করতে হবে, যাতে জনগণ দেখতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান জাতীয় শুদ্ধাচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং স্বজনপ্রীতি রোধে কোনো কর্মচারীকে নিজ প্রশাসনিক বিভাগে কাজের সুযোগ না রাখতে সুপারিশ করেছে কমিশন। তৃতীয়ত, একজন কর্মচারীকে তিন বছরের বেশি একই স্টেশনে না রাখার কথা বলা হয়েছে।

সংস্কার কমিশনের তৃতীয় অধ্যায়ে প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরে নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য 'সুশাসন প্রতিষ্ঠা'র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কী কী কারণে দুর্নীতি হচ্ছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না সেসব কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। যেমনটি পুলিশ সংস্কার কমিশনে করা হয়েছে।

ওই কমিশন পুলিশের দুর্নীতির নয়টি খাতকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে বলেছে। যেমন: মামলা গ্রহণ, পরিচালনা, চার্জশীট দেওয়া, কোর্টে আসামি চালানেও পুলিশ আর্থিক দুর্নীতি করে। এ ছাড়া, শহর এলাকার ফুটপাতে চাঁদা তোলা, হাইওয়েতে পরিবহন খাতে পুলিশের চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করেছে কমিশন।

কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে 'রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি' উল্লেখ করলেও কোনো খাতের দুর্নীতির উদাহরণ ওই  প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। 

কমিশনের প্রতিবেদনের পঞ্চম অধ্যায়ে 'দুর্নীতি বন্ধ' শীর্ষক অংশে বলা হয়েছে, 'জনসেবা ব্যবস্থার মধ্যে ঘুষ, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতির কারণে সেবাপ্রদান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং জনসেবায় দুর্নীতি বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।'

একই অধ্যায়ে জনসেবার বিরাজনীতিকরণের বিষয়ে বলা হয়েছে, জনসেবা নিশ্চিত করতে 'পক্ষপাত' ও 'দলগত' বিবেচনা পরিহার করতে হবে।

কমিশনের প্রতিবেদনে অনৈতিক, অন্যায় ও দুর্নীতি উদঘাটনে তথ্য প্রকাশকারী (হুইসেল ব্লোয়ারদের) কাজকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ লক্ষ্যে ২০১১ সালে প্রণীত তথ্য সুরক্ষা আইনটি পর্যালোচনা করে আরও বেশি হুইসেল ব্লোয়ার বান্ধব করার কথা বলা হয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথাও স্বীকার করেছে।

কমিশন বলেছে, 'জনপ্রশাসন বহুবিধ উপাদান দ্বারা তৈরি একটি কাঠামো এবং এর কর্মপদ্ধতিও অত্যন্ত জটিল। এ ছাড়া, জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী মতামত রয়েছে। সে কারণে মাত্র তিন-চার মাসের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে জনপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন প্রায় দুঃসাধ্য একটা কাজ। এ জন্য এ কমিশনের কাজের কিছু অপূর্ণতা থাকতে পারে।'

জনপ্রশাসন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া বিধায় কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য ছোট আকারে একটি স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বা সংস্কার বাস্তবায়ন কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে মুয়ীদ কমিশন।

সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো পরিচালিত করার একটা 'জেনেরিক রোডম্যাপ' প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে সংস্কার কমিশন বলেছে, 'মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জনপ্রশাসন সংস্কার কর্মসূচির একটি জেনেরিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করবে।'

কমিশন আরও বলেছে, 'বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজ নিজ সংস্কার কর্মসূচী তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে স্থায়ী সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠাবে। গঠিত স্থায়ী কমিশন সেগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ দপ্তর সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের নির্দেশ দিবে।'

স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি সেবা কার্যক্রমের ফিডব্যাক দিতে ছাত্র প্রতিনিধিসহ 'জেলা নাগরিক কমিটি' এবং 'উপজেলা নাগরিক কমিটি' গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। যারা সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে প্রতি চার মাস পরপর বৈঠক করে জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। জেলা প্রশাসন এসব প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।

এ ছাড়া, কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জনপ্রশাসনে নতুন নতুন উদ্ভাবনকে গ্রহণ এবং নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে 'উদ্ভাবনী ল্যাব' প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।

'বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন সংস্কারে জন্য ২৬টি সংস্কার কমিশন ও কমিটি গঠন করা হলেও এখনো গতানুগতিক জনপ্রশাসন ব্যবস্থা বহাল রয়েছে, যেখানে জনপ্রশাসনের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রগত হয়ে আছে।'

'সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ নেই। অধিকন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই দুর্বল বলে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়', বলে মন্তব্য করেছে কমিশন।

Comments

The Daily Star  | English

An Eid evening at Pongu Hospital: overflowing emergency, lingering waits

NITOR is a 1,000-bed tertiary medical facility that receives referral patients from all over the country

27m ago