ভোরের 'প্রভাতফেরি' কীভাবে গেল মধ্যরাতে

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে 'প্রভাতফেরি'। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এর পরের বছরেই চালু হয় এই প্রভাতফেরি। আল মাহমুদ লিখেন- প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে/ বাংলা আমার বচন/ আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।' প্রভাতফেরি আমাদের নিয়ে যায় ভাষা শহীদদের স্মৃতির মিনারে।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস পালিত হয়। এই দিবসটি পালন শুরুই হয় প্রভাতফেরি দিয়ে। সেটা সব ছাত্র সংগঠনের সিদ্ধান্তেই এটা হয়। কারো কোনো একক সিদ্ধান্তে এটা হয়নি। সেই শুরু থেকেই ভোরে প্রভাতফেরির মাধ্যমে অমর একুশে পালিত হয়। গত অন্তত তিন দশক ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। ভাষাসংগ্রামী ও সংস্কৃতিজনরা এটা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
প্রভাতফেরির ভোরে পালন বিষয়ে দৈনিক পাকিস্তানের ভাষ্য- অন্যান্য বছরের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে এবারের একুশের ডাকে এক অভিভাবিতপূর্ব সাড়া জেগেছিল শহীদের রক্তরাঙা এই নগরীতে। সাড়া জেগেছিল ছাত্র যুবক আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নগ্নপদে প্রভাতফেরিতে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নরনারী, ছাত্রছাত্রী ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জমায়েত গোটা আজিমপুর এলাকার পূর্ণ হয়ে ওঠে। (২২ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৬৯, দৈনিক পাকিস্তান)
এই বিষয়ে অধ্যাপক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শহীদ দিবসের আয়োজনকে রাত ১২টায় নিয়ে যাওয়ায় বেশ একটা নাটক ঘটার সুযোগ থাকে। তাকে অতিনাটকও বলা চলে। কর্তাদের সুবিধা হয়, তাদের কর্তৃত্ব প্রকাশের আরও একটি সুযোগ তাদের হাতে এসে যায়। ক্ষতি হয় এই দিবসটির অন্তর্গত প্রাণের। সংকুচিত হয়ে যায় তার স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বাভাবিকতা। বিঘ্ন ঘটে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। শুরু থেকে প্রভাতফেরিতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
একুশে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মধ্যরাতে একুশ উদযাপন বিজাতীয়। ইউরোপীয় প্রথা। ইউরোপীয়দের নববর্ষ মধ্যরাতেই শুরু হয়, আমাদের পহেলা বৈশাখ অতিপ্রত্যুষের ঘটনা। মাঝরাতের অন্ধকার বা কৃত্রিম আলো কোনোটাতেই, কখনো আমাদের আগ্রহ ছিল না। থাকার কথা নয়। অন্ধকারকে চিরকালই আমরা ভয়ংকর বলে মনে করি। এখনো ভয় করি।
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ছোটবেলায় আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতাম এবং তখন প্রভাতফেরি হতো ভোরবেলায়। খালি পায়ে ফুল হাতে একুশের গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। কিন্তু ঠিক কখন থেকে প্রভাতফেরিটা ভোর থেকে একুশের প্রথম প্রহরে, অর্থাৎ মধ্যরাতে চলে গেল তা ঠিক মনে নেই। প্রভাতফেরির এই সময় পরিবর্তন আমার কখনোই পছন্দ হয়নি এবং এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কমে গেছে। আরেকটা কথা, দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমরা যেন ভুলেই গেছি যে আমাদের জাতীয় জীবনে এটা শহীদ দিবস। এটা আমাদের জন্য ভালো বিষয় নয়, কারণ শহীদ দিবস এবং প্রভাতফেরি আমাদের জাতিসত্তার স্বাতন্ত্রের বিষয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে- আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অবশ্যই পালন করব কিন্তু শহীদ দিবসের যে ভাবগাম্ভীর্য এবং মর্যাদা তা যেন ভুলে না যাই।
এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্বাধীনতার আগেও শহীদ দিবস ভোরে পালিত হতো। স্বাধীনতার পর সেটা মধ্যরাতে চলে আসে। এখন দিবসটি পালন হয় নামকাওয়াস্তে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুসারে প্রভাতফেরির নিয়ে গেছে মধ্যরাতে। আমরা অমর একুশে পালনে ফিরে যেতে চাই প্রভাতে।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুরু করেছিলাম প্রভাতফেরি। প্রথম প্রভাতফেরির গান ছিল 'মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে'। সুরটিতে ছিল করুণ অনুভূতির প্রকাশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে শোনা গেছে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের লেখা গান, 'ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না এ ফেব্রুয়ারি ভুলবো না'। এতে ছিল প্রতিবাদী বলিষ্ঠতার প্রকাশ। ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' ১৯৫৩ সালে রচিত হলেও সুরারোপিত হয়ে এ গান গাওয়া হয়েছে ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে এবং এরপর থেকে নিয়মিত কানে বাজে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, বাঙালি জাতির সংস্কৃতি হিসেবে শহীদ দিবসে প্রভাতফেরি ভোরে হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক তারিখ ধরে আমাদের পালন করার মানে হয় না। প্রভাতফেরি একুশের সকালে পালনের দাবি জানাই।
Comments