মার্চেই বান্দরবানের পাহাড়ে খাবার পানির তীব্র সংকট

মার্চের মাঝামাঝিতেই বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নের থাংখ্রুই পাড়ায় পানির তীব্র সংকট দেখা গিয়েছে।
বাসিন্দারা বলছেন, গত প্রায় আট বছর ধরে গ্রীষ্মের আগেই তাদের এই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রতি বছর তারা ইউনিয়ন পরিষদে জানাচ্ছেন, কিন্তু সমাধান মিলছে না।

থাংখ্রুই পাড়ায় ৩০টি পরিবারে প্রায় ২০০ মানুষের বাস। তাদের ভাষ্য, প্রায় তিন শতক আগে তাদের পূর্ব পুরুষরা এই পাহাড়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। গ্রীষ্মকালে পানির সংকট ও বর্ষায় পানিবাহিত রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সম্প্রতি অনেকেই পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
এই পাড়ার পূর্ব-উত্তর দিক দিয়ে নেমে গেছে একটি ঝিরি। অনেকটা অর্ধচন্দ্র আকারে জড়িয়ে আছে পাহাড়কে। পানির চাহিদা মেটাতে এই ঝিরি থাংখ্রুই পাড়ার বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসা। ঝিরির শেষ মাথায় পাথর চিরে চুইয়ে পড়া পানি সংগ্রহ করেন তারা।

পানি নিতে প্রতিদিন পাহাড় থেকে প্রায় ৫০০ ফুট নিচে নামতে হয় তাদের। এতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪৫ মিনিট। সম্প্রতি পানির প্রবাহ এত কমে গেছে যে, এক কলসি পানি ভরতে সময় লাগছে কমপক্ষে এক ঘণ্টা। যে কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লাইন লেগে থাকছে।

বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে থাংখ্রুই পাড়া অবস্থিত। শহর থেকে পিচঢালা রাস্তা শেষ হয়েছে তুমচংপাড়ায়। এখান থেকে শুরু হয় পাহাড়ি পথ—নিচে বুড়ি পাড়া, উপর বুড়ি পাড়া ও সাকক্রেডং পাড়া ছাড়িয়ে আরও অন্তত ১৫ মিনিট এগোলে পাওয়া যাবে থাংখ্রুই পাড়া।
দুর্গম হলেও এই পথে মোটরসাইকেল চলে।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় শৈনুচিং মারমার। তিনি অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'ঘরে রান্নার পানি নেই, খাবার পানিও প্রায় শেষ। সকালে পানি নিতে পারিনি, অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। জুমের কাজ শেষে বিকেলে তাই আবার পানির জন্য নামতে হলো।'
'প্রতিদিন এমন কষ্ট করতে হয় আমাদের,' বলেন শৈনুচিং মারমা।
১ কলসি পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা
মেচিং উ মারমা বলেন, 'ঝিরিতে পানির নেই বললেই চলে। চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা পানিতে কলসি ভরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যায়।'
পানির প্রবাহ বাড়াতে বাঁশ কেটে পাইপের মতো করে সরু পথ তৈরি করেছেন তারা।
'একজন পানি নেওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত পরেরজনকে অপেক্ষা করতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারীদের লাইন লেগেই থাকে,' বলেন রেদামা মারমা।

৪ পাড়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট
কেবল থাংখ্রুই পাড়া নয়, পাশ্ববর্তী নিচে বুড়ি পাড়া, উপর বুড়ি পাড়া ও সাকক্রেডং পাড়াতেও একই সংকট। এসব গ্রামে দুই শতাধিক পরিবারে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় তারা অস্বাস্থ্যকর ও অপরিষ্কার পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তারা জানান, বর্ষার শুরুতে পাতা পচে পানি দূষিত হয়ে যায়। সেই পানি ব্যবহার করায় অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হন। বর্ষাকালে এখান থেকে কাউকে হাসপাতালে নেওয়াও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
ম্যুই অংপ্রু মারমা বলেন, 'আমরা বিগত বছরগুলোতে একাধিকবার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবর পানির সংকট নিরসনের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন ও জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে আসছি কিন্তু কোনো সুরাহা মেলেনি।'
'এরপর আমরা আর কোথায় যাব জানি না,' আক্ষেপ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যাসিং শৈ মারমা বলেন, 'শুধু থাংখ্রুই পাড়া নয়, আশেপাশের আরও চারটি গ্রামেও একই অবস্থা। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও সরকারের কাছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার আবেদন জানিয়েছি।'
যোগাযোগ করা হলে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জুলহাজ বলেন, 'পাহাড়ি দুর্গম এলাকা নিয়ে এখনো কোনো পরিকল্পনা নেই।'
'পাহাড়ি অঞ্চলে কঠিন শিলাস্তর ও আয়রনের মাত্রা বেশি থাকায় টিউবওয়েল বসানো কঠিন। এছাড়া, বন উজার হয়ে যাওয়ায় পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে,' বলেন জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী অনুপম দে।
তিনি জানান, কিছু এলাকায় সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।
বান্দরবানে উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী লেলুং খুমি বলেন, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
Comments