কারখানা বন্ধ: চাকরি হারানো শ্রমিকদের ঈদ আনন্দ বলতে কিছু নেই

ছবি: স্টার

গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে কারখানা বন্ধ এবং ছাঁটাইয়ের কারণে চাকরি হারিয়েছেন এমন হাজারো শ্রমিকের ঈদ আনন্দ এবার ম্লান হয়ে গেছে।

ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মতে, আর্থিক সংকটের কারণে কারখানার মালিকরা উৎপাদন ইউনিট বন্ধ অথবা ছাঁটাই ঘোষণা দেওয়ার কারণে গত সাড়ে সাত মাসে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের।

দেশের চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন ইউনিটে বিনিয়োগ বা বিদ্যমান কার্যক্রম সম্প্রসারণ থেকে বিরত থাকায় নিয়োগে গতি কমে গেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকার শঙ্কা আছে।

অনেক শ্রমিক কাজের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন, আবার অনেকে রাজধানীতে বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ কুলাতে না পেরে গ্রামে ফিরে গেছেন।

কোনো স্থায়ী আয় না থাকায়, চাকরি হারানোর কারণে ঈদে পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু কেনা তো দূরের কথা পরিবারের ভরণপোষণ এবং সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খরচ মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

আলিফ হোসেন গত বছর বেক্সিমকো কারখানা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন সিনিয়র ওয়াশিং অপারেটর হিসেবে ওভারটাইমসহ মাসে প্রায় ২৫ হাজার টাকা আয় করতেন।

বাবা-মা, স্ত্রী এবং ছেলের ভরণপোষণের জন্য একটা চাকরি খুঁজতে তিনি ঢাকাতেই রয়ে গেছেন। আশা ঈদের পরে হয়তো কোনো একটা কাজ তিনি পাবেন। ঢাকায় থাকতে তাকে প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে।

'আমি অনেক কষ্টের একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি,' বলেন আলিফ।

তবে সোহান মিয়া ঢাকায় থাকতে পারেননি। কারখানা বন্ধের আগে প্রতি মাসে ২৯ হাজার টাকা বেতন পেতেন তিনি। বকেয়া বেতন এবং সার্ভিস সুবিধা নিয়ে তিনি বগুড়ায় তার গ্রামে ফিরে গেছেন।

সোহান ঢাকা ছাড়ার আগে তার বকেয়া বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নতুন করে চাকরি আর পাননি।  স্ত্রী, বোন আর সাত বছরের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

'আমার তো কাজ নাই, পরিবারে কীভাবে ঈদের আনন্দ থাকে?'

কুড়িগ্রামের মিলন মিয়া, যিনি আগে সিনিয়র সুপারভাইজার হিসেবে মাসে ৩৫ হাজার টাকা আয় করতেন, এখন একটি সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানায় অস্থায়ী দৈনিক মজুরির কাজ করছেন।

'এই ঈদে বাবা-মা, ভাইবোনসহ পাঁচ সদস্যের ভরণপোষণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে আমার জন্য,' বলেন মিলন।

সাভারের একটি পোশাক কারখানায় ৩২ বছর ধরে সিনিয়র স্টোর-ইন-চার্জ হিসেবে কাজ করা এক ব্যক্তি চাকরি হারানোর পর এখন পর্যন্ত কোনো কারখানায় যোগ দিতে পারেননি।  

'আমার দুটি সন্তান স্কুলে যেতে পারছে না,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৫ লাখ টাকা পরিষেবা সুবিধা এবং বকেয়া পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু কর্তৃপক্ষ আর ফোন কল ধরছে না। তাই কবে সেই টাকা পাবো সেটা অনিশ্চিত।

কারখানার নাম উল্লেখ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, সরকার শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য তাদের সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছিল, কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ সেই টাকা বিতরণ করেনি।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কারখানাগুলো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে কারাগারে পাঠানোর পর ১৪টি টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস ইউনিট বন্ধ করে দেয়।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় এবং পরে ভাঙচুর, লুটপাট বা অগ্নিসংযোগের শিকার কারখানাগুলো আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং মালিকদের গ্রেপ্তার ও মামলার কারণে পুনরায় চালু হতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর মধ্যে গাজী গ্রুপের পাঁচটি টায়ার কারখানা, বেঙ্গল গ্রুপের তিনটি প্লাস্টিক কারখানা এবং আশুলিয়া, সাভার, জিরাবো এবং জিরানির মতো শিল্পাঞ্চলে অসংখ্য পোশাক কারখানা রয়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, 'গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে কারখানাগুলো তারল্য সংকটের মুখে পড়ে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারকে বেকার শ্রমিকদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

তিনি বলেন, অনেক শ্রমিক বেকার ছিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে নতুন কারখানা খুলেছে এবং পুরোনো কারখানা সম্প্রসারিত হয়েছে যেখানে অনেকে পুনরায় চাকরি পেয়েছেন।

তবে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পুনরায় নিয়োগ দিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা সমস্যার মুখে পড়ছেন, বলেন মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বেকার শ্রমিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে তহবিল দিয়েছে সরকার সেটি ব্যবহার করে বেকারত্ব বীমা স্কিম তৈরি করতে পারে যাতে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা এই ধাক্কা সামলাতে পারে।'

কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান স্বীকার করেন যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে কতগুলো কারখানা বন্ধ হয়েছে তার সঠিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

শ্রমিকদের পুনরায় নিয়োগের বিষয়ে শফিকুজ্জামান বলেন, বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সদস্য কারখানা এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ইউনিটগুলোতে শ্রমিকরা যাতে চাকরি খুঁজে পেতে পারে সে বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, বেক্সিমকো ছাড়াও সরকার পেমেন্ট জটিলতায় থাকা ছয়টি পোশাক কারখানাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান এই ঈদে শ্রমিকেরা যে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা তুলে ধরেন।

'যদিও বেক্সিমকো থেকে চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা সরকারি সহায়তায় সেবা সুবিধা পেয়েছেন, তবুও অনেকেই বেকার আছেন, তিনি বলেন।

বেতন পরিশোধ

প্রাথমিকভাবে, শিল্প পুলিশ ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করার ঝুঁকিতে থাকা ২০৩টি কারখানার তালিকা তৈরি করেছিল, যা বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএও অতিরিক্তভাবে যাচাই করেছিল।

এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য বকেয়া নগদ প্রণোদনা থেকে সরকার প্রায় ২ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। যার ফলে আরও মূল্যায়নের পর এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, সরকার পেমেন্ট সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছে।

বিজিএমইএ প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ৯৮টি সদস্য কারখানাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু পুনর্মূল্যায়নের পর মাত্র পাঁচ থেকে ১০টি কারখানা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়াও তারল্য ঘাটতি মোকাবিলায়, বিজিএমইএ অনাদায়ী ক্যাশ ইনসেনটিভ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে।

গত সপ্তাহে সরকার ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য আরও ৩২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের কাজ চলছে। তবে, প্রায় সাতটি কারখানা ঈদের আগে কেবল বোনাস দিতে পারবে, ছুটির পর পর্যন্ত বেতন প্রদান স্থগিত থাকবে, বলেন  আনোয়ার হোসেন।

শিল্প পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন, ঈদের আগে কারখানাগুলোতে বকেয়া বেতন পরিস্থিতি আগের বছরের তুলনায় খারাপ, বিশেষ করে যেসব সংস্থাগুলি বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্য নয় সেগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পুলিশ বিজিএমইএ এবং বিকেএমইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে পেমেন্ট সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে।

Comments

The Daily Star  | English
NSC shop rent scam in Dhaka stadiums

Shop rent Tk 3 lakh, but govt gets just Tk 22,000

A probe has found massive irregularities in the rental of shops at nine markets of the National Sports Council (NSC), including a case where the government receives as little as Tk 22,000 in monthly rent while as much as Tk 3 lakh is being collected from the tenant. 

16h ago