দ্রোহ, সমতা আর সুরে রঙিন বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উদযাপন। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উদযাপন। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

ভোরের আলো ফুটতেই জীবন্ত হয়ে উঠল ঢাকার রাস্তাগুলো। লাল-সাদার সমুদ্রে স্নাত হয়ে নারী, পুরুষ ও শিশু—সবাই নেচে গেয়ে নতুন মৌসুম ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাল। 

এটা শুধু উৎসব নয়—যেন এক উদ্দাম বাঙালিয়ানার বিস্ফোরণ! যেখানে গান-রঙ-মিলনের জোয়ারে সর্বজনীন পথচত্ত্বর বছরের পর বছর ফিরে পায় তার মালিকানা।

অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বৈশ্বিক অস্থিরতার এই বছরে—বিশেষ করে যখন আমরা একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের শেষ শিকড়টুকুও উপড়ে ফেলার লড়াইয়ে—এই পহেলা বৈশাখ এনেছে এক বিরল উপহার: সামষ্টিক আশার অগ্নিশিখা। এটা শুধু আনন্দ-উৎসব নয়, এটা এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ—জগতকে জানান দেওয়া যে আমরা এখনও অটুট, এখনও গানে-প্রাণে জাগ্রত, এখনও দাঁড়িয়ে আছি হৃদয়ে অদম্য দৃঢ়তা নিয়ে।

আজ রমনা বটমূলে যখন ধ্বনিত হলো নজরুলের অমর বাণী—'মৃত্যু নাই, নাই দুখ, আছে শুধু প্রাণ', তখন তাৎক্ষণিকভাবে সূর্যোদয়ের দীর্ঘ সময় আগে থেকে সেখানে জমায়েত হওয়া জনতা এতে মৌন সম্মতি জানাল। যারা আট মাস আগে রাস্তায় নেমে শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তারাই আজ ফিরে এলো নতুনভাবে—বিক্ষোভে নয়, উদযাপনে।

শাহবাগ মোড়ের সেই একই রাস্তাগুলো—যেখানে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের চেতনা মিশে আছে, যেখানে জুলাই-আগস্টে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল—আজ লাল হয়ে উঠেছে উৎসবের রঙে, এক নতুন সূর্যোদয়ের সূচনায়। 

শান্তি, সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার আশায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অসংখ্য মানুষ তাদের প্রিয়জনদের নিয়ে পথে নেমেছে। গর্বের সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার জন্য তারা এসেছে। এ এমন এক সংস্কৃতি, যা প্রতিরোধ, অন্তর্ভুক্তি ও আত্মপরিচয়ের মাঝে নিহিত।

'ফ্যাসিবাদের কালো ছায়া থেকে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করতে চাই', বললেন পদযাত্রায় অংশ নেওয়া এক ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ। ঢাক-ঢোলের সুতীব্র আওয়াজেও তার কণ্ঠ দৃঢ়। 'তারা আমাদের চেতনা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চেয়েছে। কিন্তু সংস্কৃতি—প্রকৃত সংস্কৃতি—আমাদের মধ্যেই বেঁচে থাকে। এটা প্রতিরোধ করে, টিকে থাকে এবং অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে। আজ আমি এখানে এসেছি সবার সঙ্গে পথ চলতে। আমার নিজের মাঝে ওই প্রতিরোধের অনুভূতির জেগে ওঠা অনুভব করতে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত ফারহানা বলেন, কাজের কারণে আগের মঙ্গল শোভাযাত্রাগুলোতে যেতে না পারলেও এ বছর না এসে পারেননি তিনি। 'নিজের মধ্যে একটি সুগভীর সাংস্কৃতিক জাগরণ অনুভব করছি। বাঙালি হিসেবে আমাদের উৎসবগুলো পালন করে নিজেদের আত্মপরিচয়কে অটুট রাখতে হবে। এটা এখন আর ঐতিহ্য নয়—এটা বৃহত্তর পরিসরে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অংশ।' 

পাশেই আট বছর বয়সী শোকরজা ফড়িং আঁকড়ে ধরেছিল তার বাবা আরিফুল সবুজের হাত। তার ছোট্ট শরীরটি ঐতিহ্যবাহী নকশা সম্বলিত লাল-সাদা পাঞ্জাবিতে মোড়ানো। সে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে উঁচু মূর্তিগুলোর দিকে ইশারা করে বলল, 'আমি কখনো এত বড় কাঠামো দেখিনি!'

তারপর চোখ বড় বড় করে বলল, 'মেলা মেলা লাগছে! আমি তো প্রতি বছর এখানে আসব।'

শোকরজার মতো অগণিত রঙিন পোশাকে রাঙানো শিশুদের সড়কগুলোতে দেখা যায়। তাদের সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। অনেকেই উৎসবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। 

শোভাযাত্রার সঙ্গে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত মানুষ যোগ দিতে থাকে। তাদের হাতে ছিল একতারা, দোতারা ও খমক থেকে শুরু করে ঢাক, ঢোল ও খোলের মতো বাঙালি বাদ্যযন্ত্র। তাদের সমবেত সুরধ্বনির অনবদ্য ছন্দে আন্দোলিত হয় জনতা।

শোভাযাত্রায় উজ্জ্বল হলুদ বাঘ, টকটকে লাল পালকি আর হিংস্র কালো দানব—সবগুলোই প্রতিরোধের প্রতীক—জনতার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কাগজের মাছ, ফুলের মুখোশ আর বিশালাকার প্রপগুলো মেট্রোরেলের নিচের রাস্তাকে আলোকিত করেছে, শহরকে রূপান্তরিত করেছে শিল্প ও আত্মপরিচয়ের এক প্রাণবন্ত চিত্রকবিতায়।

জনতার হাতে হাতে ছিল বিভিন্ন বার্তাবাহী প্ল্যাকার্ড—কিছু উৎসবমুখর, কিছু রাজনৈতিক—'রামপাল বাতিল করো', 'জুলাই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাই', 'ইলিশের দাম কমাও', 'ফিলিস্তিন মুক্ত কর', 'শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দাও', 'বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল কর', 'বামপন্থি বেসামরিক নাগরিকদের মুক্ত কর', 'ভাত দিব না'—এবং আরও নানা দাবি। গাঢ় রঙে আঁকা এই বার্তাগুলো উৎসবের মাঝেও জানান দিচ্ছিল: জনতা শুধু উদযাপনেই মত্ত নয়, তারা সক্রিয়ভাবে গড়ে তুলছে নিজেদের ভবিষ্যৎও।

ইতোমধ্যে ঢাকার সড়কগুলোতে ঘটে যায় নানা রঙের বিস্ফোরণ। উৎসবের পতাকার মতো উড়ছিল লাল-সাদা শাড়ি, ঘুরে বেড়াচ্ছিল কাগজের মুখোশ পরা আর গালে নানা রঙ মাখানো শিশুরা, আর ঢাকের বাদ্য যেন সমষ্টিগত হৃৎস্পন্দনের মতো স্পন্দিত হচ্ছিল।

মানুষের ভারে শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি ও ঢাকার অন্যান্য পাড়া-মহল্লায় তিল ধারণের ঠাই ছিল না। কাছেই ধানমণ্ডিতে সকাল ছয়টায় সুরের ধারায় নতুন বছরের উদযাপন শুরু হয়। 'স্বদেশের' চেতনার প্রতি এক প্রাণবন্ত শ্রদ্ধা জানিয়ে—এই স্বদেশ, যেটা আমাদের সবার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। আদিবাসীদের লোকসংগীত ও নাচও পরিবেশন করা হয়। তারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেই সেখানে অংশ নেন।

এই কঠিন সময়েও মানুষ আঁকড়ে ধরেছে এই বার্ষিক আচারকে—যেন এটি একটি সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার, একটি পুনর্জন্ম, একটি স্মরণ—যেটি আনন্দ, বিদ্রোহের মতোই—টিকে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে।

সূর্য যত ওপরে উঠেছে, ঢাকের বাজনা তত জোরে বেজেছে—আর বাংলাদেশের মানুষ মনে করিয়ে দিয়েছে নিজেদের, এবং গোটা বিশ্বকে—সংস্কৃতি কোনো বিলাসিতা নয়। এটা এক জীবনের টানাপড়েনের মাঝেও টিকে থাকার আশ্রয়। অনিশ্চয়তার মুখে তারা আবারও ফিরে গেছে নিজের ঐতিহ্যের কাছে, সুরের কাছে, এবং একে অন্যের পাশে। আর তাতেই তারা সাহস করে আশাবাদী হয়েছে—একটি ভবিষ্যতের জন্য, যেখানে আনন্দ বিনা বাধায় ভাগাভাগি হবে, যেখানে প্রতিরোধের ছন্দ থাকবে তাল-মাত্রায়, আর 'বাঙালিয়ানার'র চেতনা এগিয়ে যাবে নির্ভীকভাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda leaves London for Dhaka in air ambulance

Fakhrul urges BNP supporters to keep roads free, ensure SSC students can reach exam centres

11h ago