'বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রথম ১০০-৩৬০ দিন নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে'

ব্যস্ত সময় পার করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাহদি আমিন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সবাই তার কাছে জানতে চান তারেক রহমানের পরিকল্পনা, নীতি ও ভাবনার বিষয়ে।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের জিনা তাসরিনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
সংস্কার নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয়নি, তখন থেকেই বিএনপি ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এ বিষয়ে কথা বলে আসছেন। তাই প্রশ্ন ওঠে—ছয়টি সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবে দলটি কেন বিরোধিতা করেছে?
মাহদির উত্তর, 'আমরা যেসব প্রস্তাবে বিরোধিতা করেছি, তার অনেকগুলোই পরীক্ষামূলক বলে মনে হয়েছে—এমন উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও তেমন নেই। আমরা বিশ্বাস করি, পরিবর্তন হওয়া উচিত টেকসই ও বাস্তব সম্মত। সেগুলো দেশের মানুষের সংস্কৃতি ও স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।'
'যেমন: সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে এবং সংসদের সব কমিটির নেতৃত্ব বিরোধী সংসদ সদস্যদের হাতে থাকবে।'
'এনসিসিতে ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিরোধী দলগুলোর জন্য বেশি সদস্য রাখা নির্বাচনী নীতিমালার পরিপন্থী। কারণ, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেরই বেশি প্রভাব থাকার কথা। এই কাঠামো বিরোধী দলকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলে সরকার পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা অস্থিতিশীল হতে পারে। এ ধরনের ভারসাম্যহীনতা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে পাবেন না এবং এমন কিছু হলে কার্যকর শাসনব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।'
'বাংলায় দেশের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবটিও প্রতীকী উদ্যোগ বলেই মনে হয়েছে। এটা বাস্তবে কোনো সংস্কার নয়।'
'এ ধরনের পরিবর্তনে নাগরিক জীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান হবে না। বরং, বাস্তব সমাধান প্রয়োজন এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মনোযোগ সরে যেতে পারে। ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া নামটি এর উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারেন।'
ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর নির্ধারণের প্রস্তাবটিও বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। মাহদি জানান, বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশে এই বয়সে ভোট দেওয়ার নিয়ম আছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপির মতে, 'এটা পাঁচ বছর হওয়া উচিত। যেমনটা অন্যান্য দেশে প্রচলিত ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় আছে।'
'যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু লাতিন আমেরিকান দেশে প্রচলিত প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থার চার বছরের মেয়াদ বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত না,' বলেন তিনি।
বিএনপির ৩১ দফা ঘোষণা অনুযায়ী কেউ যেন পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকতে পারেন—এ অবস্থানে দলটি অটল। তবে কমিশনের প্রস্তাব ছিল, একজন ব্যক্তি তার পুরো জীবনে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
মাহদি বলেন, 'আমরা যদি ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্রের সবচেয়ে ভালো উদাহরণগুলো দেখি, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের কোনো সীমা নেই। দেশের সবচেয়ে উদার রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরাই প্রথম এই প্রস্তাব দিয়েছি এবং এখনো সেই অবস্থানে আছি। এর পেছনে যুক্তি ছিল—নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি করা এবং একইসঙ্গে পূর্ববর্তী জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও সফল নেতাকেও আবার সুযোগ দেওয়া, যাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।'
গত বছর ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে দলীয় নেতৃত্ব ও অন্যান্য অংশীজনদের মধ্যে হওয়া আলোচনা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, 'সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরবিরোধী করে তোলা হয়েছে—যা দুর্ভাগ্যজনক।'
তিনি বলেন, 'তখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচন আয়োজন করা।'
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরু থেকেই বিএনপি চারটি ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা জোর দিয়ে বলেছে। সেগুলো হলো—নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ।
মাহদি বলেন, 'এগুলোর ব্যাপক সংস্কারের অজুহাত এখন নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাপক সংস্কার নিয়ে তখন কোনো আলোচনা হয়নি।'
'আমরা দেখতে পাচ্ছি, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়াতে নতুন নতুন কৌশল ও প্রক্রিয়া বের হচ্ছে। তখন প্রশ্ন ওঠে—এটা কি গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আমরা মানুষের মুখে শুনেছি, ১৬ বছর ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত জনগণ তাদের সেই অধিকার ফিরে পেতে চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো, মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা।'
হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় সরকারের অংশ হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে বিএনপি ভুল করেছে কিনা, জানতে চাইলে মাহদি বলেন, 'এই সরকারের অংশ হলে বিএনপি দেড় দশকের সংগ্রামের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করত। কারণ, এই সংগ্রাম ছিল বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।'
যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তখন দুটি পক্ষের মধ্যে একটি ছিল—রাজনৈতিক দল, যারা গত ১৬ বছর ধরে লড়াই করেছে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে চায়; আর অন্যটি, অরাজনৈতিক অংশীজন, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু তাদের নির্বাচন করার অভিপ্রায় নেই।
'আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছিল যে, যারা অন্তর্বর্তী সরকারে যাবে, তারা যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে। আর যারা নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা সরকারের বাইরে থাকবে। এই কারণেই সব রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকার থেকে দূরে ছিল।'
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে দায়িত্ব পালন করছে, তা অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেন মাহদি। আট মাস পার হয়ে গেলেও নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকার বিষয়টি তিনি এর একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
'একটি জনসম্পৃক্ত ও সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা জানি, মানুষের প্রত্যাশা হলো যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচন। শহরকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে গিয়ে তৃণমূলের বাস্তব সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার এখনই সময় অন্তর্বর্তী সরকারের।'
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত সহিংসতার বিচার কার্যক্রমের ধীরগতি এবং আহত ও ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মাহদি বলেন, 'বিএনপি নিজেদের সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে।'
'যদিও সবার বিশ্বাস ও প্রত্যাশা ছিল যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তারপরও একজন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন।'
এই নতুন রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বড় হচ্ছে বলে মনে করেন মাহদি।
তিনি বলেন, 'তাদের মধ্যে অন্তত দুজন এখনো অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন এবং আমরা এখনো জানি না তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না। প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই ছাত্র প্রতিনিধিদের দেখতে পাচ্ছি এবং সেখানে স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে। তারা কি তাদের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের?'
এই স্বার্থের দ্বন্দ্ব যত দ্রুত সম্ভব নিরসন করা উচিত উল্লেখ করে মাহদি বলেন, 'একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ন্যায্য রাজনৈতিক পরিসর গঠনের অংশ হিসেবে আমরা তাদের আহ্বান জানাই—তারা যেন যেকোনো রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেন।'
তার মতে, গণতন্ত্রে সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই গতিশীল ও চলমান প্রক্রিয়া।
'এখন যদি কেউ বলে—সব সংস্কার নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে করা হবে, তারপর নির্বাচিত সরকার আসবে। তাহলে প্রশ্ন আসবে যে, নির্বাচিত সরকার কি কোনো সংস্কার করবে না? দেশ কি তখন স্থবির হয়ে যাবে? এটা হয় না।'
তিনি বলেন, 'বিএনপি সংস্কারকে সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে। এটা কেবল সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নিশ্চিত করাই নয়, বরং ব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটিগুলো ঠিক করে জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।'
মাহদি গত দেড় দশক ধরে প্রগতিশীল, সহনশীল ও নিয়মতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে তারেক রহমানের ভিশনকে রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ব্রিটিশ একাডেমিয়ার উদীয়মান মেধাবী বাংলাদেশিদের সহযোগিতা নিয়ে নিজের ভিশনকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তবভিত্তিক রূপ দিতে তারেক রহমানের প্রচেষ্টা থেকে ২০১১ সালে মাহদির সঙ্গে তার পরিচয়।
মাহদি তখন ব্যবস্থাপনায় পিএইচডি করছিলেন। পাশাপাশি তিনি যোগ দেন তারেক রহমানের টিমে এবং কাজ শুরু করেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে। ২০১৪ সালে তাকে তারেক রহমানের উপদেষ্টা করা হয়।
মাহদি বলেন, 'বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টারধারার গণতন্ত্রের সর্বোত্তম প্রয়োগের সুযোগ তিনি আমাকে দিয়েছেন। ২০১১, ২০১২, ২০১৩—এই সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এত বড় পরিবর্তনের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না—কিন্তু তারেক রহমান সেটা ভেবেছিলেন। এটাই ছিল সেই ভিশন। বিশেষ করে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের ধারণা আকর্ষণ করে তারেক রহমানকে।'
তারেক রহমানের এই ভিশন ৩১ দফা আকারে ২০২৩ সালে ঘোষণা করা হয়। দেশ-বিদেশে বিএনপির অসংখ্য পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ ও গণতন্ত্রপন্থী অংশীজনদের সঙ্গে কর্মশালা করে, বাস্তবভিত্তিক গবেষণা করে এবং তৃণমূল পর্যায়ের মতামত নিয়ে তৈরি করা হয় এই ৩১ দফা।
'গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকা সমমনা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মতামত এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তারাও এটি গ্রহণ করেছেন।'
মাহদি বলেন, ৩১ দফার প্রতিটি প্রস্তাব সবার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, '৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি শুধু রাষ্ট্র কাঠামোতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই নয়, বরং প্রতিটি পেশা ও পটভূমির মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়ন ও তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধান করবে। বিএনপির সবচেয়ে বড় গর্ব হলো—বাংলাদেশে আজ সংস্কার নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তার প্রায় সব বাস্তবসম্মত ও ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবই এসেছে ৩১ দফা থেকে।'
তিনি জানান, তারেক রহমানের নির্দেশনায় এসব সংস্কার ও উন্নয়ন নীতির প্রতিটির জন্য নিবেদিত ব্যাকএন্ড টিম কাজ করছে।
তিনি জানান, যদি এখনই বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে প্রথম ১০০ দিন, ১৮০ দিন এবং ৩৬০ দিনে কী করা হবে সে বিষয়ে তারেক রহমানের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে।
মাহদি বলেন, 'আমাদের নেতা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এবং তিনি তার বক্তব্যে শুধুমাত্র সেই প্রতিশ্রুতিগুলোই দিচ্ছেন, যেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।'
মাহদির ভাষ্য, এসব টিম ও তাদের রোডম্যাপ নির্বাচনের আগে প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এ টিমের অর্থনীতি ও ব্যবসা সংক্রান্ত পরিকল্পনার একটি ঝলক দেখানো হয়েছে বলেও মন্তব্য তার।
'কীভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করব? কীভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব? শ্রমিক ও কৃষক কীভাবে তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবে? কীভাবে সবাইকে মানসম্পন্ন বহুভাষিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করব? কীভাবে যানজট সমস্যা সমাধান করব? কীভাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখব? আমাদের নেতা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করেছেন।'
প্রশ্ন আসে—ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকা কী ছিল?
মাহদির ভাষ্য, বিএনপি—বিশেষ করে তারেক রহমান—প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ্যে যতটা কৃতিত্ব নিয়েছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত ছিলেন এই আন্দোলনে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গণঅভ্যুত্থানে প্রায় এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। মাহদির দাবি, এর মধ্যে ৫০০ জনের বেশি ছিলেন বিএনপির কর্মী। বিএনপির প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার মধ্যে শীর্ষ নেতারাও ছিলেন; কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয় এবং জেলা অফিসগুলোতে ভাঙচুর করা হয়।
'তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনে একক কৃতিত্ব নিতে চায় না বিএনপি।'
মাহদি বলেন, 'প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সবসময়ই শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাঠে ছিল। কিন্তু যখন কোনো শাসকদল মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে, তখন সেই সরকারকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরানো যায় না—একটি গণঅভ্যুত্থান প্রয়োজন হয়।'
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঠিক এটাই ঘটেছিল।
তিনি বলেন, '১৬ বছর পর প্রথমবারের মতো দেশের ভেতরে ও বাইরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়াজ তোলে এবং রাজপথে নেমে আসে। বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে ছিলেন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন।
এই আন্দোলন সফলভাবে সম্পন্ন করতে তারেক রহমান কতটা নিরলসভাবে কাজ করেছেন তা তুলে ধরেন মাহদি।
এরপর আলোচনা চলে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সরকারের দায়িত্ব নিতে কতটা প্রস্তুত—সেই প্রসঙ্গে।
তিনি বলেন, 'আমাদের দক্ষতা আছে, মানবসম্পদ আছে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—দেশের উন্নয়নের জন্য অঙ্গীকার রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারগুলো ইতোমধ্যেই সেই প্রমাণ দিয়েছে।'
দুর্নীতি নির্মূল করাই হবে বিএনপি সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি।
গত ১৬ বছরে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তা অনুসন্ধান করে বিএনপি একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এবং জনগণ যেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে, সেই ব্যবস্থা চালু করবে।
বিএনপি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে, যারা দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিভিন্ন পদে নিয়োগের বিষয়গুলো যাচাই করবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও প্রতিষ্ঠান দখলের চলমান অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহদি বলেন, 'এ ধরনের কর্মকাণ্ডে "জিরো টলারেন্স" নীতি প্রয়োগ করছেন তারেক রহমান। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য, এ ধরনের ঘটনায় অনেক ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।'
তিনি বলেন, '৫ আগস্টের পর আমরা অনেককে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখেছি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি একমাত্র দল হিসেবে প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করছে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, এমন প্রায় দুই হাজার সদস্যকে বহিষ্কার করেছে।'
বর্তমানে যে পরিকল্পিত প্রচারণা চলছে, সেটা নতুন কিছু নয় বলে মনে করেন তিনি। তার ভাষ্য, বিএনপি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব চলছে বহু আগে থেকেই।
তিনি বলেন, 'পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেও আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি।'
মাহদি বলেন, দল গঠনের শুরু থেকেই বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল এবং এখনও তাই আছে।
তিনি বলেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতের শিকার হিসেবে বিএনপি জাতির কাছে অঙ্গীকার করছে—এ ধরনের প্রতিহিংসা আর কখনো বরদাস্ত করা হবে না। আমরা এমন বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করছি, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন।'
বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে দলের অবস্থান হবে 'জিরো টলারেন্স'।
তিনি বলেন, 'বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশ ও বহুবিধ মতাদর্শের সমাজে দীর্ঘদিন বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের নেতা তারেক রহমান এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চান, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও মতাদর্শ একসঙ্গে থাকতে পারে।'
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ভিশন কতটা বাস্তবসম্মত—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তারেক রহমান মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও স্কুল কারিকুলামের মাধ্যমে জনগণকে শিক্ষিত ও সম্পৃক্ত করতে কাজ করবেন।'
এ ছাড়া, বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শ হলো 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'। যার অর্থ, জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করা এবং ধর্ম, জাতি, বর্ণ, বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রতিটি বাংলাদেশির সমান অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রনীতি 'সমতা, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার'র ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে।
তিনি বলেন, 'আমাদের মূল দর্শন হলো—বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক স্তরে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলবে যেখানে কোনো প্রভু নয়, কেবল বন্ধু থাকবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয় স্বার্থের বিনিময়ে কোনো পক্ষ নেবে না, বরং পারস্পরিক স্বার্থভিত্তিক নীতি গ্রহণ করবে। আমরা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করতে চাই এবং এই সংযুক্ত বিশ্বে একটি দায়িত্বশীল অংশীজন হিসেবে ভূমিকা রাখতে চাই।'
এবার সেই বহু আলোচিত প্রশ্ন—কোনো আইনি বাধা না থাকার পরও তারেক রহমান দেশে ফিরছেন না কেন এবং তিনি কবে দেশে ফিরবেন?
তিনি বলেন, 'বারবারই বলা হয় তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন। এটা কেবল সময়ের ব্যাপার। তিনি জনগণের মাঝেই থাকতে চান, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে চান এবং যারা এখনো জেলে আছেন বা মিথ্যা রাজনৈতিক মামলার শিকার হয়েছেন, তাদের অধিকার রক্ষায় লড়াই করতে চান।'
Comments