মা ও শিশুর পুষ্টিতে কিছু অগ্রগতি হলেও চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে

মা ও শিশুর পুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জন করলেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা খর্বাকৃতি, রক্তশূন্যটা, জন্মের সময় কম ওজন ও শৈশবকালীন অতিরিক্ত ওজন হ্রাস এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এ লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, মাতৃদুগ্ধ পানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুষ্টি কর্মসূচিতে আরও বেশি যুব সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন তারা।
গতকাল ডেইলি স্টার সেন্টারে দ্য ডেইলি স্টার ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে আয়োজিত 'বাংলাদেশে শিশু পুষ্টি' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব বলেন।
মূল প্রবন্ধে আইসিডিডিআরবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, যদিও এসডিজি ২ বিশেষভাবে পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এর ছয়টি লক্ষ্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো—খর্বাকৃতি, রক্তশূন্যতা, জন্মের সময় ওজন কম, শৈশবের অতিরিক্ত ওজন, বুকের দুধ খাওয়ানো এবং পুষ্টির অভাব।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে মাতৃদুগ্ধ পানের হার এখন ৫৫ শতাংশের আশেপাশে আছে। তার মানে দেশে ছয় মাসের কম বয়সী প্রায় অর্ধেক শিশু সম্ভবত বুকের দুধ পাচ্ছে না। এমনকি এই নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায়ও বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে।'
খর্বাকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে¬—২০১১ সালের ৪১ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, 'কিন্তু ২১ শতাংশের মানে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন খর্বকায়। তার মানে পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বাকৃতির জন্য বাংলাদেশ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না।'
যদিও পুষ্টিহীনতার হার ২০১১ সালের ১৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, এটি এখন ১৮ শতাংশের মতো হতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ডাব্লিউএইচও'র জরুরি কাটঅফ ১৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বাজেট বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তিনি তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, কিশোরীদের পুষ্টির দিকে মনোনিবেশ করা, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য নিয়ে প্রচারণা, মাতৃদুগ্ধ পান ও পরিপূরক খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে আলোচনার জন্য মায়েদের ক্লাব গঠন এবং মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা মোকাবিলার সুপারিশ করেন।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ২০১৭ সালের ৬৫ শতাংশ থেকে কমে ২০২২ সালে ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, 'অনেক মা বুকের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্ব নিয়ে সচেতন নন এবং পোশাক কর্মীসহ অনেক কর্মজীবী মা সম্পূরক খাবারের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন।'
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফাহমিদা শারমিন জ্যোতি বলেন, মাত্র ৪১ শতাংশ নারী গর্ভপূর্ব সেবা পান।
তিনি বলেন, 'যদি আরও বেশি সংখ্যক নারীকে প্রসবপূর্ব সেবার আওতায় আনা যায়, তাহলে তাদের শিশু ও মাতৃত্বকালীন পুষ্টির বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হবে। এটি কম ওজনের শিশুর জন্মের হার কমাতে সহায়ক হবে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, 'গর্ভাবস্থা থেকেই শিশু পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।'
তিনি নিরাপদ পানি ও যথাযথ স্যানিটেশন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পারিবারিক শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থা পুষ্টি নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক আনজুমান আরা সুলতানা বলেন, 'বাজেট বরাদ্দ ও জনবল বাড়াতে হবে এবং পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে যথাযথ তহবিলের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।'
ইউনিসেফ বাংলাদেশের পুষ্টি বিভাগের প্রধান দীপিকা মেহরিশ শর্মা বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত ফেব্রুয়ারি থেকে গত এক বছরে তীব্র রুগ্নতায় ভোগা শিশুর সংখ্যা ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি গত বছরের বন্যা, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ও অর্থ কমার কারণে রেশন হ্রাসের মতো কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেন।
দীপিকা মেহরিশ শর্মা বলেন, 'অপুষ্টির সমস্যা থেকে বের হতে একটি জীবনচক্র পদ্ধতির প্রয়োজন এবং এই সমস্যা সমাধান কেবল স্বাস্থ্য খাতের কাজ নয়। এ সমস্যা সমাধানে বেসরকারি খাত বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের অবদান রাখতে হবে।'
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর রুদাবা খন্দকার বলেন, পুষ্টি সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং এই সমস্যা মোকাবেলায় আরও তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নির্বাচিত সভাপতি আবু জামিল ফয়সল পুষ্টির জন্য বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন, যেগুলো প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়—প্লাস্টিকের ব্যবহার, কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও সীসার বিষক্রিয়া।
'এগুলো হলো অদৃশ্য শত্রু, যারা পুষ্টি গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করে,' বলেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, 'একদিকে আমরা আমাদের শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টি দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। অন্যদিকে আমরা তাদের প্লাস্টিক, কীটনাশক ও রাসায়নিক দিচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা কেমন সমাজে আছি? আমার কষ্ট লাগে যে—আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে এমন আচরণ করছি।'
'দ্য ডেইলি স্টার এ বিষয়ে আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে। আমরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় পর্যালোচনা করব।'
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন—বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী আলী কাওছার, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের উপ-পরিচালক ফারজানা রহমান, আইসিডিডিআর,বি'র পুষ্টি গবেষণা বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক থাডিয়াস ডেভিড মে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের লাইন ডিরেকটর মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়েট রিলেটেড রিস্ক ফ্যাক্টরের প্রোগ্রাম অফিসার সামিনা ইসরাত।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন দ্য ডেইলি স্টারের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট টিমের এনজিও ও বিদেশি মিশনের ইনচার্জ তানজিম ফেরদৌস।
Comments