‘উপদ্রুত এ-উপকূলে তবু জীবনের বাঁশি বাজে’

কালাবগিতে কষ্টের জীবন থেমে থাকে না। রুক্ষ বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা সঙ্গে রেখেই মানুষ স্বপ্ন বোনে। মিলন হয়। জনপদে জন্ম নেয় নতুন শিশু। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এ পাড়ার মানুষগুলো 'গরীবের মধ্যে গরীব। ছোটলোকের মধ্যে আরও বেশি ছোটলোক'। এখানকার ঝুলন্ত ঘরগুলোর মতোই তাদের জীবনও সর্বক্ষণ ঝুলে থাকে জন্ম-মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকা অদৃশ্য সুতোয়।

কিন্তু ঝড়ের ছোবল, তুফানের চোখরাঙানি, বাঘের ভয়, কুমিরের দাপট, তীব্র ক্ষুধা, ভয়ংকর তৃষ্ণা, নিদারুণ দারিদ্র আর রোগ-শোকের চাবুকেও সে জীবন সহসা টলতে চায় না।

এ জনপদ যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে উঠে আসা বিংশ শতাব্দীর সেই কেতুপুর; জন্মের উৎসব যেখানে 'গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন'।

ভঙ্গুর বসত। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের শেষ জনপদ এই কালাবগি। এর পশ্চিমে শিবসা ও পূর্বে সুতারখালী নদী। শিবসা তীরের পশ্চিমপাড়া বলে পরিচিত লোকালয়ে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পূবে তাকালে চোখে পড়বে এমন শয়ে শয়ে ঝুলন্ত ঘর।

কাঠ-বাঁশের খুঁটির ওপরে মাচা পেতে বানানো হয়েছে এসব মাথা গোঁজার ঠাঁই। জোয়ারে প্রায়ই ঘরের পাটাতন বা মাচা ভিজে যায়। পাড়াটির অবস্থান আর ঘরের ধরনের জন্য এ বসতির নাম হয়েছে ঝুলন্তপাড়া। কেউ বলেন 'ঝুলনপাড়া'।

এই ঝুলনপাড়ার সব বাসিন্দাই ভূমিহীন। নদীভাঙনে সব হারানো মানুষগুলোর ঠাঁই হয়েছে এখানে। এর ওপারেই সুবিস্তৃত সুন্দরবন।

অকালপ্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর 'গহিন গাঙের জল' শিরোনামের কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলো কালাবগির মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন প্রসঙ্গে বেশ প্রাসঙ্গিক—'গহিন গাঙের ঘোলা নোনাজল উথালি পাথালি নাচে/ফনা তুলে আসে তুফানের সাপ কাফনের মতো শাদা/পরানের 'পরে পড়ে আছড়ায়ে বিশাল জলের ক্রোধ—/যেন উপকূল ভিটে মাটি ঘর টেনে নিয়ে যাবে ছিঁড়ে।'

এখানে প্রতি পদে বিপদ। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে এই ঝুলন্তপাড়ায় ৬০০-৭০০ পরিবারের বাস। জীবিকা চলে নদী থেকে বাগদা-গলদার রেণু সংগ্রহ করে, মাছ ধরে। অনেকে সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করেন।

নদীর ওপর পাড়ার বাসিন্দাদের ঘরগুলো সুন্দরবনের কাকড়াগাছের খুঁটি, শিরীষ কাঠের পাটাতন ও গোলপাতার বেড়া দিয়ে তৈরি। বড় আকারের জোয়ার ও ঝড় হলে নির্ঘুম রাত কাটে পাড়ার মানুষগুলোর।

বিপদে ঠাঁই নেওয়ার জন্য পাড়ার আশপাশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। চিকিৎসাসেবা নিতে নৌপথে যেতে হয় ৩০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরে। সবচেয়ে কাছের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতেও লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। খুব বেশি তৃষ্ণা না পেলে এই এলাকার মানুষ পানি খান না। রান্নার পানি আনতে হয় দুই কিলোমিটার দূর থেকে। খাওয়ার পানি আনতে হয় অন্য উপজেলা থেকে। ‍পুরো এলাকায় সবুজের চিহ্ন নেই।

এই জনপদে নারীর জীবন আরও কঠিন। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ও পাড়ার স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই এই এলাকায় ঝুলন্ত ঘর তৈরির এই প্রবণতা শুরু হয়। এরপর কয়েক দফা নদীভাঙনে যাদের বসতভিটা শিবসা কিংবা সুতারখালীর পেটে গেছে, তাদেরও ঠাঁই হয়েছে এখানে। সর্বশেষ সিডর ও আইলার আঘাতের পর পাড়ার পরিধি বেড়েছে। বেড়েছে বিপদের পরিধিও।

লেখক-গবেষক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা তার এক লেখায় জানাচ্ছেন, সুন্দরবনের ভেতরের নদী আর খাঁড়িগুলোতে কুমিরের স্বাভাবিক খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় কুমির লোকালয়ের কাছে চলে আসছে। সুন্দরবনের কুমিরদের প্রধান খাবার মাছ আর কাঁকড়া। বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া আহরণ, নিধন ও রপ্তানি কুমিরের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

ফলে আগে যেখানে কুমির কালেভদ্রে ভদ্রা নদী বেয়ে সুতারখালী নদীতে আসত; এখন সেই কুমির প্রায়ই জোয়ার কিংবা ভাটায় ঘরের নিচে ঘুরঘুর করছে।

ঝুলনপাড়ার মাঝে নদী, ওপারে সুন্দরবন। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এতকিছুর পরও কালাবগিতে কষ্টের জীবন থেমে থাকে না। সেখানেও উঁকি নিয়ে যায় হাসির সূর্য। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা সঙ্গে রেখেই মানুষ স্বপ্ন বোনে। মিলন হয়। জনপদে জন্ম নেয় নতুন শিশু।

প্রতি পদে বিপদ আর অনিশ্চয়তায় মোড়ানো কালাবগির মানুষদের এ জীবন ধরার সাধ্য কোনো গল্প-কবিতার নেই। তারপরও কবি রুদ্রের মতো বলতে ইচ্ছে হয়—'রোদ্দুরে পোড়া জোস্নায় ভেজা প্লাবনে ভাসানো মাটি,/চারিপাশে তার রুক্ষ হা-মুখো হাভাতে হাঙর-জল।/উজানি মাঝির পাঞ্জায় তবু বিদ্যুৎ জ্ব'লে ওঠে/জ্ব'লে ওঠে তাজা বারুদ-বহ্নি দরিয়ার সম্ভোগ—/উপদ্রুত এ-উপকূলে তবু জীবনের বাঁশি বাজে।'

Comments

The Daily Star  | English

New polls timing: BNP upbeat, process irks Jamaat, NCP

The interim government’s revised election timeline with certain conditions has stirred cautious optimism as well as raised questions among  political parties.

8h ago