ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ হাজার ছাড়াল, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

ফাইল ফটো | ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সোনাইপুল এলাকায় নদীর তীর থেকে গত ২২ মে উমেদ আলী (৪৭), তার স্ত্রী সেলিনা বেগম (৪১) ও তাদের তিন মেয়েকে উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তারা জানান, উমেদ, সেলিনা এবং তাদের কন্যা রুমি খাতুন (১৬), রুম্পা খাতুন (১৫) ও ছয় বছর বয়সী সুমাইয়া খাতুনের শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।

পরিবারটিকে প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রানা। তিনি বলেন, 'তারা স্তম্ভিত ছিল। বাচ্চারা ছিল ভীত এবং মনে হচ্ছিল ঠান্ডায় জমে গেছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করে বিজিবিকে জানাই।'

তাদের অভিযোগ, ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা ফেনী নদীতে তাদের ফেলে দিয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধারের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহামুনী ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের হেফাজতে নেন।

সেলিনা জানান, তারা যেন পানিতে ভেসে থাকতে পারেন, সে জন্য তার ও তিন মেয়ের শরীরে অনেকগুলো প্লাস্টিকের খালি বোতল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

'আমরা সারা রাত ভেসে ছিলাম। আমরা কেউই সাঁতার জানি না,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

পরিবারটি জানায়, তারা হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। পরে তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় এনে নদীতে ফেলে দেয়।

উমেদ আলী বলেন, 'তারা তোয়াক্কাই করেনি যে, আমাদের সঙ্গে বাচ্চারাও ছিল।'

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ভারত থেকে অসংখ্য মানুষকে এভাবে নির্যাতনের পর সীমান্ত এনে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

গত ১০ মে এক নারী ও তার স্বামীকে দিল্লি পুলিশ আটক করে এবং আরও ৪৬ জনের সঙ্গে থানায় নিয়ে যায়। ৪৫ বছর বয়সী ওই নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানান, তারা গত ১০ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন।

'তারা আমাদের হেফাজতে নেয়। তিন দিন কোনো খাবার বা পানি দেয়নি। এরপর রাতের আঁধারে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়,' বলেন তিনি।

গত মঙ্গলবার লালমনিরহাট সীমান্তের শূন্যরেখায় এক বছর বয়সী মরিয়াম আক্তারকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন মানিকজান বেগম। আর এক পা এগোলেই নতুন জীবন শুরু হতে পারে। কিন্তু সে জীবন অনিশ্চয়তার।

এসব 'পুশ ইন' এর ঘটনা এবং অসহায় নারী-শিশুদের হেফাজতে নিয়ে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক।

বিজিবি সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মোট এক হাজার ৫৩ জনকে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে।

বিজিবি বলছে, খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১১১ জন, কুড়িগ্রাম দিয়ে ৮৪, সিলেট দিয়ে ১০৩, মৌলভীবাজার দিয়ে ৩৩১, হবিগঞ্জ দিয়ে ১৯, সুনামগঞ্জ দিয়ে ১৬, দিনাজপুর দিয়ে দুই, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে ১৭, ঠাকুরগাঁও দিয়ে ১৯, পঞ্চগড় দিয়ে ৩২, লালমনিরহাট দিয়ে ৭৫, চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ১৯, ঝিনাইদহ দিয়ে ৪২, কুমিল্লা দিয়ে ১৩, ফেনী দিয়ে ৩৯, সাতক্ষীরা দিয়ে ২৩ ও মেহেরপুর দিয়ে ৩০ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।

এছাড়া, সুন্দরবনের দূরবর্তী মণ্ডারবাড়িয়া এলাকা দিয়েও ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে বারবার প্রতিবাদ জানানোর পরও বিএসএফ ও ভারতীয় অন্যান্য সংস্থাগুলো এ ধরনের "পুশ ইন" কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।'

'বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে এবং স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করেছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার কথা স্বীকার করছে না, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মিথ্যাচারের শামিল,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'যাদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তাদের অনেকে বাংলাদেশি হলেও বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন।'

'তাদের সন্তানদের অনেকের ভারতেই জন্ম এবং তাদের ভারতের কাগজপত্র ছিল। জোরপূর্বক কাগজপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে,' বলেন তিনি।

বিজিবি মহাপরিচালক আরও বলেন, 'আমরা বারবার বলেছি, এ ধরনের একতরফা পদক্ষেপ স্বীকৃত প্রত্যাবাসন ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই হবে।'

সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২২ মে হরিয়ানার বাসিন্দা পাঁচ বাংলাদেশি নারী-শিশুকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

এর আগে ৭ মে ভারতের ইউএনএইচসিআর-নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গাকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, 'এসব ঘটনায় তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। অনেকে শারীরিক নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন।'

'বিজিবি প্রতিটি ঘটনার তথ্য, ছবি ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে যথাযথ চ্যানেলে ভারতকে জানিয়েছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

2h ago