১৪৪ ধারা কী, কেন জারি হয়

বাংলাদেশে ফৌজদারি কার্যবিধির যে ধারাগুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত তার মধ্যে ১৪৪ ধারা অন্যতম। এর ক্ষমতাবলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজন মনে করলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত বা মিছিল নিষিদ্ধ করতে পারেন।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক।
ধারাটির ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান জানান, ব্রিটিশ ভারতে প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৯৮ সালে প্রণয়ন করা আইনের এই ধারাটি বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হলেও মানুষের জানমাল রক্ষায় এর ব্যবহারের বহু নজির আছে।
আরিফ খান বলেন, আইনের এই ধারা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সরকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোন জায়গায় কোন বিশেষ সময়ের জন্য জনসমাবেশ, অস্ত্র বহন করা, মিটিং-মিছিল করা এমনকি আড্ডা দেওয়াও নিষিদ্ধ করতে পারে।
কোন পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা জারি করা যায়
জমায়েত হওয়া কিংবা সমাবেশ করার বিষয়টি সাংবিধানিক অধিকার হওয়ায় স্বাভাবিক সময়ে সরকার এতে বাধা দিতে পারে না। কিন্তু যদি মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বা বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন আইন সরকারকে সেই অধিকারে সীমারেখা টানার ক্ষমতা দেয়। এক্ষেত্রে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই সরকার আগাম ব্যবস্থা নিতে পারে।
কে ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন
১৪৪ ধারা জারি করার ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত। সাধারণত একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি) এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সেই সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন।
এই আদেশ একটি নির্বাহী আদেশ বা ঘোষণার মাধ্যমে জারি করা হয়।
কার্যকরের পদ্ধতি
১৪৪ ধারা জারির বিষয়টি জনগণকে অবহিত করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: মাইকিংয়ের মাধ্যমে ঘোষণা। লিফলেট বিতরণ। প্রকাশ্য স্থানে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া।
এই ঘোষণায় নির্দিষ্ট এলাকার সীমানা উল্লেখ করা থাকে এবং কেবল সেই নির্ধারিত এলাকার মধ্যেই এই আদেশ বলবৎ থাকে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যবহার
প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে ব্রিটিশ আমলে এই ধারাটি সিআরপিসিতে যুক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়েও এর উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি এবং গোষ্ঠীগত সংঘাত প্রতিরোধ করা। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভিন্নতা এসেছে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং তাদের সভা-মিছিল বন্ধ করার জন্য এই ধারার ব্যাপক অপব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে। তবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এর ইতিবাচক ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
১৪৪ ধারা জারি হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যেমন—পুলিশ, বাড়তি কোনো আইনি সুরক্ষা বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা লাভ করে না। তাদের কাজ হলো আদেশটি কার্যকর করা। যদি কেউ এই ধারা অমান্য করে, তবে পুলিশ তাকে কেবল গ্রেপ্তার করতে পারে। ধারা ভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার করার জন্য যেটুকু বলপ্রয়োগের প্রয়োজন, শুধু সেটুকুই আইনসিদ্ধ। এর বাইরে লাঠিচার্জ করা বা গায়ে হাত তোলার মতো কোনো কাজ করার আইনগত বৈধতা পুলিশের নেই, যেমনটা সাধারণ সময়েও থাকে না।
১৪৪ ধারা জননিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য একটি আইনি হাতিয়ার। তবে এর কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে এর বিবেচনাপ্রসূত ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের ওপর।
Comments