অন্তর্বর্তী সরকারের ১ বছর

অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ-পদোন্নতি প্রশাসনে সংকট বাড়িয়েছে

সচিবালয়
ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও জনপ্রশাসনে এখনো বিরাজ করছে অস্থিরতা। এলোমেলো পদোন্নতি ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা আরও বেড়েছে।

আমলাতন্ত্রকে দক্ষ ও নিরপেক্ষ করার জন্য সংস্কার শুরুর বদলে নিয়মিত কর্মচারীসহ অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের একের পর এক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, যার মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত ও অযোগ্য।

এর ফলে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের তরুণ কর্মচারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩১তম বিসিএস ব্যাচের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে অনেক অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাসহ কিছু যোগ্য কর্মকর্তাকেও এভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে করে বিপুলসংখ্যক আমলা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। যারা গত সরকারের আমলে প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাদের পদোন্নতি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু, বিভাগীয় মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত ও দুর্নীতিবাজ অনেকেও পদোন্নতি পেয়েছেন, এটা ভবিষ্যত প্রশাসনের জন্য বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত হয়ে থাকবে।'

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নতুন করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১১৯ জনকে সচিব ও ৫০০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত করা হয়।

সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তাকে উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে। এত স্বল্প সময়ে এমন পদোন্নতি নজিরবিহীন। অথচ, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের সিভিল সার্ভিস এখনো অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুর। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শীর্ষ পর্যায়ে কিছু অদক্ষ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।'

সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, 'এর জন্য শুধু কর্মকর্তারাই দায়ী নন; যারা তাদের বেছে নিয়েছেন তারাও সমানভাবে দায়ী।'

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনিক কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে এবং সচিবালয়ে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পরও বহু কর্মকর্তা কাজে যোগ দেননি, অনেকে আবার অফিসে এলেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। অনেকে নিজেদের 'বঞ্চিত' দাবি করে প্রায় প্রতিদিন সচিবালয়ে জড়ো হয়েছেন নানান দাবি নিয়ে। ফলে, নিয়মিত প্রশাসনিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।

টালমাটাল প্রশাসনিক কাঠামো সচল করতে সরকার পর্যায়ক্রমে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এরপর ঘন ঘন রদবদল ও কর্মকর্তাদের ওএসডি (বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়, যা অস্থিতিশীল আরও বাড়িয়ে দেয়।

পেশাদার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পরও আগের সরকারের মতোই চলছে সব। পদোন্নতি ও বদলিতে এখনও মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব।

উদাহরণ হিসেবে বিতর্কিত এক কর্মকর্তার পদোন্নতির প্রসঙ্গ তুলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিতে জড়িত এক কর্মকর্তাকে গত বছরের ডিসেম্বরে উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতি করেছেন বলে মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে উঠে আসে। এই কারণে তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্ত বলেন, '২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই প্রবণতাকে অস্বাভাবিক ও প্রকাশ্য পক্ষপাতদুষ্ট পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।'

রাজস্ব ক্যাডারের এক কর্মকর্তা জানান, বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলার কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়েছে অথবা অন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হাতাহাতির ঘটনায় জড়িত প্রশাসন ক্যাডারের ১৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে সত্যতা মিললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের কয়েকজনকে বরং উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে।'

প্রশ্ন রেখে এই কর্মকর্তা বলেন, 'কোনো একটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে মারামারি বা দুর্নীতি যাই করুন তাদের কিছুই হয় না, বরং ভালো ভালো পদায়ন ও পদোন্নতি পান। আমরা কীভাবে এই প্রশাসনের প্রতি আস্থা রাখব?'

একই প্রশ্ন তোলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও।

গত এক বছরে অন্তত নয় জন সচিব ও ১৯ জন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে এবং আরও ৮৭ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। তবে দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এসব কর্মকর্তাদের হঠাৎ সরিয়ে দেওয়ায় প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় বাধা সৃষ্টি করেছে।

সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, 'অনেক দক্ষ কর্মকর্তাকে নির্বিচারে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই দুর্বল হয়ে গেছে।'

তার মতে, প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মানেই কোনো ব্যক্তি দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়িত—এটা ঠিক না। যারা দুর্নীতি করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াই উচিত। কিন্তু দূরে ঠেলে দেওয়া অনেক ভালো কর্মকর্তাও আছেন। সরকারের উচিত তাদের বিষয়গুলো আরও পরীক্ষা করে দেখা।'

কিশোরগঞ্জের সাবেক এক জেলা প্রশাসক বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর জনপ্রশাসনকে আরও দক্ষ করার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে সেই সুযোগ নষ্ট হয়েছে।'

প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য গত বছরের অক্টোবরে সরকার সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের বিবরণী প্রকাশের জন্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কর্মকর্তারা সেগুলো জমা দিলেও মন্ত্রণালয় এখনো সেগুলোর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এই উদ্যোগকে 'আইওয়াশ' আখ্যা দিয়ে তরুণ কর্মকর্তারা জানান, শীর্ষ আমলারা খুব ভালোভাবেই জানেন কারা দুর্নীতিগ্রস্ত, সরকার চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে তা নেওয়া হয় না।

প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৫ বছরে যেসব আইন-কানুন শিথিল করা হয়েছে, সেগুলো সংশোধন করে আরও কঠোর করার জন্য এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার ফলে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিতে জড়ানোর সুযোগ বেড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী আদালতে একদিনের জন্যও দণ্ডিত হলে চাকরিচ্যুত হতেন। কিন্তু ২০১৮ সালে বিধিমালায় সংশোধনী আনা হয় এবং এখন এক বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও চাকরিতে বহাল থাকতে পারেন।

গত এক বছরে এসব বিধিমালা কঠোর করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং বিতর্কিত রেকর্ডধারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া, মন্ত্রণালয় কোনো অভ্যন্তরীণ সংস্কারও শুরু করেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সচিব বলেন, 'জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কার্যত অভিভাবকবিহীনভাবে চলছে। কারণ, এখানে কোনো উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে অনেক সম্ভাবনাময় জুনিয়র কর্মকর্তা বিদেশে পোস্টিং বা উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুঁজছেন।'

মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

Comments

The Daily Star  | English
health sector reform in Bangladesh

Health sector reform: 33 proposals set for implementation

The Health Ministry has selected 33 recommendations from the Health Sector Reform Commission as it seeks to begin implementing the much-needed reform process in the country’s health system.

15h ago