রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ: ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত

কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্প। গতকাল তোলা ছবি। ছবি: রাজীব রায়হান/ স্টার

২০১৭ সালের পর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এএ) ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে নতুন করে আরও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার সঙ্গে নতুন করে এই বিশাল সংখ্যক মানুষ যুক্ত হয়েছে। এর ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় দাতা সংস্থার তহবিল কমানোর ঘোষণা। এই আর্থিক সহায়তা কমার কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা এমন সব কারণে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি, যাতে আমাদের কোনো দায় নেই।

তিনি বলেন, 'এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ মানবিক ও নিরাপত্তাজনিত পরিণতি দেখা দিতে পারে।'

এদিকে রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আরাকান আর্মি ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষের কারণে টেকনাফ সীমান্তজুড়ে শত শত মানুষ জড়ো হচ্ছে। এতে নতুন করে আবারও অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রত্যাবাসনের চেষ্টা

মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন চুক্তি হলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারেনি। এরপর চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়।

কোভিড-১৯ মহামারির সময় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ কিছুটা ধীর হয়ে যায়। ২০২৩ সালের শেষ দিকে নতুন করে চেষ্টা করা হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ের কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়।

কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক সাইফুল বলেন, 'আগে মিয়ানমার সেনারা আমাদের বিরুদ্ধে ছিল, এখন আরাকান আর্মি আমাদের বিরুদ্ধে।'

রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে জিনিসপত্রের ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং আরও বেশি রোহিঙ্গা পালাতে বাধ্য হচ্ছে।

গত ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, 'অনেক রোহিঙ্গা লালদিয়ায় জড়ো হয়েছে… মানুষ আতঙ্কে পালাতে চাইছে। আবারও বড় আকারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ হতে পারে।'

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'রাখাইনের নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির কারণে এখন প্রত্যাবাসন সম্ভব না। তবে আমরা বিকল্প পথ খুঁজছি।'

রোহিঙ্গারা বলছে, সেখানকার পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয় এবং তাদের নিরাপত্তা বা নাগরিকত্বের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ঢাকায় চীনা দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, চীন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি আলোচনায় বসতে রাজি নয়। 'আমরা যুদ্ধবিরতির অপেক্ষায় আছি।'

ঢাকার কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের বড় অংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে, রাখাইনেও এখন আরাকান আর্মি কর্তৃত্ব করছে।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য একদিকে সামরিক জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি, আবার সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য আরাকান আর্মিকেও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।

জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই পরিস্থিতি ঢাকাকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য আরকান আর্মির সহায়তা প্রয়োজন, আবার মিয়ানমারের স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ হিসেবে সামরিক জান্তার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সেটি একটি অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো দেখাতে পারে, যা নেপিদোর সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে চীন ও ভারতের অবস্থানও বিবেচনায় রাখতে হবে।

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, শুধু ট্র্যাক-ওয়ান কূটনীতি (সরকারি আনুষ্ঠানিক কূটনীতি) নয়, প্রয়োজনে ট্র্যাক-টু (শিক্ষাবিদ, এনজিও প্রভৃতি) ও ট্র্যাক-থ্রি (নাগরিক কূটনীতি) অনুসরণ করতে হবে।

বাড়ছে নিরাপত্তা উদ্বেগ, কমছে সাহায্য

২০২৫-২৬ সালের জন্য প্রয়োজনীয় ৯৩৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে মাত্র ৩৩৮ মিলিয়ন ডলার বা ৩৬ শতাংশ তহবিল পাওয়া গেছে, যার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল হ্রাস।

এরই মধ্যে কয়েকশ জাতিসংঘ ও এনজিও কর্মী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ১১০০-এর বেশি শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন।

ইউনিসেফ প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুরক্ষা সেবাতেও প্রভাব পড়ছে।

আরআরআরসির মিজানুর রহমান বলেন, স্থানীয়রা প্রথমে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানালেও এখন ক্ষুব্ধ। কারণ, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করছে, ফলে চাকরি ও মজুরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি সতর্ক করেন, অর্থায়ন কমতে থাকলে মাদক ও মানবপাচারের মতো অপরাধ আরও বাড়বে।

এদিকে আরাকান আর্মি ও জান্তার সংঘর্ষ সীমান্ত অতিক্রম করায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল জোরদার করেছে।

বিচারে অচলাবস্থা

জাতিসংঘ তদন্তকারীরা রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতাকে 'গণহত্যা' হিসেবে বর্ণনা করেছে। ২০১৯ সালে গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) একটি মামলা দায়ের করে, যা মিয়ানমারকে নতুন করে নৃশংসতা প্রতিরোধের নির্দেশ দেয়।

২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং-এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেন, যা এখনও ঝুলে আছে।

কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'আইসিসি এখনও জান্তা নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেনি, এটা দুর্ভাগ্যজনক। রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার পুরোপুরি অধরাই রয়ে গেল।'

বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে-এর প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০১৭ সালে গণহত্যা ঘটিয়েছে এবং আইসিজের নির্দেশ সত্ত্বেও এএ এখন রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করছে। 'এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পুরোপুরি ব্যর্থতা।'

বাংলাদেশ এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলনের আগে, বাংলাদেশ কক্সবাজারে একটি অংশীদার সংলাপের আয়োজন করছে। চীন, ভারত এবং জাপান ছাড়াও বাংলাদেশ আসিয়ান-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, তার সরকার মিয়ানমারে একটি আসিয়ান শান্তি মিশন পাঠাবে।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর বলেন, 'আমরা জরুরি ও স্থায়ী সমাধান চাই… আর কতদিন আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে তাদের রাখতে পারব? তাদের অবশ্যই নিজ দেশে ফিরতে হবে।'

Comments