৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

বিএনপির পরিকল্পনা ‘অহিংস’ আন্দোলন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্দলীয় সরকারের দাবিতে 'অহিংস' আন্দোলন চালিয়ে নিতে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি এই আন্দোলনে যত বেশি সম্ভব জনসস্পৃক্ততা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্দলীয় সরকারের দাবিতে 'অহিংস' আন্দোলন চালিয়ে নিতে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি এই আন্দোলনে যত বেশি সম্ভব জনসস্পৃক্ততা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের ভাষ্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গুম, খুনসহ সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির নানা অভিযোগ সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে তারা এ বিষয়গুলোকেই কাজে লাগাতে চান।

সেইসঙ্গে কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে সরকারি দল ও পুলিশের বাধা এবং মামলা-হামলা থেকে বাঁচতে খানিকটা কৌশলী থাকার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন নেতারা। বলছেন, এ ক্ষেত্রে অবস্থা বুঝে ধাপে ধাপে বিরতি দিয়ে তারা এই আন্দোলন সংঘটিত করতে চান। সারা দেশের পাশাপাশি তারা বিশেষ নজর দিতে চান ঢাকার কর্মসূচিগুলোর দিকে।

আজ ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথনে দলের ২ ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানমেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের রাজনীতির ধরন ও কৌশল নিয়ে এমন ভাবনার কথাই জানিয়েছেন।

ইতোমধ্যে বিএনপি জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কিছু কর্মসূচি শুরু করেছে। ২২ আগস্ট থেকে ঢাকার বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ কর্মসূচি শুরুর দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হামলা, মারধর ও বাধার মুখে পড়েছে দলটি।

আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করতে গিয়েও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক যুবদল কর্মী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, নেত্রকোণা ও নাটোর থেকেও বিএনপির কর্মসূচিতে সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের হামলা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

এর আগে জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে গত ৩১ জুলাই ভোলায় বিএনপির বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রদল নেতা নূরে আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুর রহিম। এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিএনপি। সর্বশেষ গত ১১ আগস্ট তারা রাজধানীতে বড় জনসমাবেশ করে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে নয়াপল্টনে বিএনপির সমবেশ। ১১ আগস্ট ২০২২। ছবি: এমরান হোসেন/স্টার

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, 'শত প্রতিকূলতার ভেতরেও সমাবেশগুলো করা হচ্ছে। হাজারো এমনকি লাখো মানুষের সমাবেশও হয়ে গেছে। কেবল দলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারা এটা হয় না। জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। সেই সম্পৃক্ততা আছে বলেই আন্দোলনের নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।'

এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, 'আমরা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চাই। এখন এই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা আছে। জনগণকে ডাক দিলেই তারা আসছে। এই জনসম্পৃক্ততা নিয়েই এই সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের চলমান আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই।'

এ ছাড়া এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হবে না বলেও মন্তব্য করেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। বলেন, 'ইতোমধ্যে ২টি তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, যেখানে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। তাই তাদের (বর্তমান সরকার) অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা অংশ নেব না।'

দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, 'আমাদের নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বর্তমান যে পরিবেশ, তাতে আমরা আশান্বিত যে, জনগণের সম্পৃক্ততায় দেশে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠবে। সেই আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ হবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আমরা এই সরকারের পরাজয় ঘটাতে পারব।'

দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন খানের ভাষ্য, 'সরকারের দমন-পীড়ন রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এশিয়া মহাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর এত অত্যাচার-নির্যাতন হয়নি।'

এমন পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোতে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে টিকে থাকাই কঠিন। কিন্তু আমাদের তো উপায় নেই। আন্দোলনে নেমে যেহেতু গিয়েছি, কন্টিনিউ করতে হবে। মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে আবার এ ধরনের কর্মসূচি দিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আরেকটা বিষয় হচ্ছে ঢাকা শহরে বেশি করে কর্মসূচি দিতে হবে। বাইরে আমরা যতই শক্তি দেখাই, ঢাকা শহরে যদি জনগণকে সম্পৃক্ত না করা যায়, তাহলে এর পরিবর্তন হবে না। সুতরাং আগামী দিনগুলোতে ঢাকা শহরে আরও বেশি করে লোক সমাগম করা দরকার।'

বর্তমানে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা খুব উজ্জীবিত আছেন মন্তব্য করে হাফিজ বলেন, 'পুলিশের বিরুদ্ধে, অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে তো নিরস্ত্র মানুষ যুদ্ধ করতে পারে না। তবে এসব করে কোনো সরকার পার পায় না। এর ফল আলটিমেটলি খারাপই হয়। কিছু মানুষের জীবন অকালে ঝরে যায়। যেমন- ভোলায় ২টা ছেলে মারা গেল। এর নেক্সট রেজাল্ট হলো স্বৈরতন্ত্র উৎখাত হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।'

জনগণ সঙ্গে থাকলে এই আন্দোলনের একটা সফল পরিসমাপ্তি আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, 'বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ব্যবহার করছে কেবল কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, জীবনের নিরাপত্তা— সবকিছু ফিরিয়ে আনার কঠিন দায়িত্ব জাতীয়তাবাদী দলের ওপর পড়েছে।'

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বলেন, 'এই দায়িত্ব পালন করার জন্য যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা বেশ কিছু মোটিভেশন ওয়ার্ক করেছি সংগঠনের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত। এটা ধারাবাহিকভাবে এখনো চলছে।'

আলালের ভাষ্য, 'দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা— এমন একটি দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ একটি তাঁবু খুঁজছে, আশ্রয় খুঁজছে। তারা মনে করছে, বিএনপি সেটা দিতে পারবে। এ জন্য বিএনপির যেকোনো কর্মসূচিতে আগের চেয়ে উপস্থিতি যেমন বেশি, তেমনি ওই বিক্ষোভ বা সমাবেশগুলাতেও লোকজনের সাড়াটাও ব্যাপক। তাদের শারীরিক ও মৌখিক প্রতিক্রিয়া আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি। এই স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা ব্যাগ্র হয়ে আছে।'

Comments