‘নির্বাচন ছাড়াই সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া যায়… নির্বাচন সম্পূর্ণ অনুৎপাদনশীল একটি খাত’

‘নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচন আয়োজনে ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে, প্রার্থীদের খরচও ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে 'নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার' কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দীন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের প্যানেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টারের পরিচালক। 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ'র একাংশের সভাপতি ও মুখপাত্র।

ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্‌দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও পরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন জামাল উদ্দীন। আজ সোমবার সন্ধ্যায় কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। আপনি কি বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলবেন?

অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন: ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আমরা আওয়ামী লীগ ৫ বছরের জন্য সংসদ গঠন করেছি, সরকার গঠন করেছি। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে সরকার, সংসদ, বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়—কেউই ঠিকভাবে কাজ করতে পারিনি। সংসদও যেহেতু সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি, সেইক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ ইচ্ছা করলে ৫ বছর বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে করোনা দুর্যোগের বিবেচনায়। আমি মনে করি, অন্তত ২ বছর তো বাড়ানোই যায়। কারণ, ২ বছর তো সমস্ত কিছুই একেবারে প্যারালাইজড ছিল।

ডেইলি স্টার: এখন অবস্থা কি স্বাভাবিক হয়েছে না?

জামাল উদ্দীন: হ্যাঁ, কিন্তু ২টা বছর তো লস্ট (হারিয়ে গেছে)। এই সময়ের মধ্যে কোনো কিছুই কাজ করেনি। আমরা যত যাই বলি না কেন, করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি বেশ নাজুক। এমনকি নির্বাচনের জন্য সরকারের যেমন একটা খরচ হবে, তেমনি প্রার্থীদেরও হবে। তাদের আর্থিক অবস্থাও তেমন একটা ভালো না। এসব বিবেচনায় এই সংসদের মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।

রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সকলের সঙ্গে সংলাপ করে ঐক্যমতে পৌঁছানো গেলে সেটা ৫ বছরই হতে পারে। এটা শুধু একা সরকার করবে তা নয়। সরকার, নির্বাচন কমিশন, বিরোধী দল—সবাই আলোচনা করবে। একটি নির্বাচন করতে প্রচুর খরচ হয়। সরকারের নির্বাচন আয়োজনের খরচ ও প্রার্থীদের প্রচারণার খরচসহ ফর্মাল-ইনফর্মাল হাজারো কোটি টাকার ব্যাপার।

নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচন আয়োজনে ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে, প্রার্থীদের খরচও ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

নির্বাচন সম্পূর্ণ অনুৎপাদনশীল একটি খাত। তারপরও নির্বাচন করলে আমরা কী পাব, আর কী পাব না, তা নিয়ে একটা শঙ্কা আছেই।

ডেইলি স্টার: ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেক্ষেত্রে দেশে একটি সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কি জরুরি না?

জামাল উদ্দীন: আগের নির্বাচনে কী বিতর্ক ছিল বা আগামী নির্বাচনে কী হবে, সেটা নিয়ে আমি কথা বলিনি। আমি বলেছি, মহামারির কারণে সরকার কাজ করতে পারেনি সেই বিষয়ে।

ডেইলি স্টার: নির্বাচন ছাড়া সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া, নাকি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন—আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সেই  হিসেবে আপনার মতামত জানতে চাইছি।

জামাল উদ্দীন: নির্বাচন যাদের নিয়ে করবেন, সেই সরকারি দল, বিরোধী দল বা অন্যান্য গোষ্ঠী—সবার মধ্যে নির্বাচন করার মতো সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নেই। এই বিষয়টি নিয়েও চিন্তা করতে হবে। সহিংসতা এড়াতে জাতীয় ঐক্যমত তৈরির জন্যও একটা সময় দরকার।

ডেইলি স্টার: জানতে চাইছি কোনটা জরুরি, নির্বাচন ছাড়া সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি না সুষ্ঠু নির্বাচন?

জামাল উদ্দীন: করোনা মহামারির কারণে সংসদ ২ বছর কাজ করতে পারেনি। কোনোকিছুই ঠিকমত চলেনি…

ডেইলি স্টার: এ কথা আপনি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। জানতে চাইছি…

জামাল উদ্দীন: করোনা মহামারির…

ডেইলি স্টার: আমাকে প্রশ্নটি করতে দিন… প্রশ্নটি করতে দিন… তারপর আপনি বলবেন… জানতে চাইছি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, না নির্বাচন ছাড়া সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরি মনে করেন?

জামাল উদ্দীন: সরকার একা না, বিরোধীদলসহ সবাই আলোচনা করে সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নিলে কোনো সমস্যা নেই।

ডেইলি স্টার: বিরোধী দল ও সরকারি দল আলোচনা করে একটি ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারবে, এমন পরিবেশ দেশে আছে?

জামাল উদ্দীন: আলোচনা তো করতে হবে। আলোচনা ছাড়া তো নির্বাচন হবে না। এখন উস্কানিমূলক কথাসহ দেশের কেমন পরিস্থিতি, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।

ডেইলি স্টার: যদি বর্তমান সরকারের মেয়াদ বাড়ানো হয় বা নির্বাচনের আয়োজন না করা হয়, তাহলে কি এই উস্কানি থেমে যাবে বা সহিংসতা এড়ানো যাবে?

জামাল উদ্দীন: যদি জাতীয় পর্যায়ের সংলাপে সবাই ঐক্যমতে পৌঁছায় যে নির্বাচনের মাধ্যমে এত বড় খরচে আমরা যাব না, তাহলে সেটা হতে পারে।

ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অবস্থা, জনগণের ভোটের বিষয়টার কী হবে?

জামাল উদ্দীন: জনগণের ভোটের ব্যাপার তো আছেই। আমাদের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ—সবাই তো জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। জনগণের কল্যাণে জাতীয় পর্যায়ের সংলাপের মাধ্যমেই যদি সিদ্ধান্ত আসে, তাতে সমস্যা কোথায়?

ডেইলি স্টার: জনগণের ভোটের দরকার নেই?

জামাল উদ্দীন: জনগণের ভোটের অধিকারের বিষয়টি অস্বীকার করছি না। কিন্তু, করোনা মহামারি, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অব্যাহত থাকলে কি নির্বাচন করতে পারতেন?

ডেইলি স্টার: সেটা কি এখন অব্যাহত আছে?

জামাল উদ্দীন: এখন নেই, কিন্তু টানা ২ বছর তো ছিল।

ডেইলি স্টার: এখন সবই স্বাভাবিকভাবে চলছে। তাহলে নির্বাচনে সমস্যা কী?

জামাল উদ্দীন: মহামারির ভয় মানুষের মনের ভেতরে চলে গেছে। এখনো মানুষ শঙ্কামুক্ত না।

রাজনৈতিক দলগুলো এবং সুশীল সমাজ জাতীয় পর্যায়ের সংলাপের ভিত্তিতে এই ৫ হাজার কোটি থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী খরচ বাঁচাতে পারে।

ডেইলি স্টার: গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটের তাহলে কী হবে?

জামাল উদ্দীন: এই সংসদ বা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো—এক সময় তারাও সংসদ সদস্য ছিলেন—নির্বাচন করবে। তারা সবাই যদি একত্রিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ের সংলাপ করতে পারে, তাহলে বরং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। ৫ বছর নির্বাচন না করলে এমন কিছুই হবে না। সবার আগে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ও জাতীয় ঐক্যমত। এগুলো ঠিক না থাকলে কি আগামী ৫-১০ বছরে নির্বাচন করতে পারবে?

ডেইলি স্টার: নির্বাচন না করলে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো হয়ে যাবে?

জামাল উদ্দীন: আমরা মনে করি, সরকার ও বিরোধী দল আন্দোলনের ভেতরে আছে, দেশের সুশীল সমাজ ও মিডিয়াও যথেষ্ট শক্তিশালী, আমাদের ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠানগুলোও যথেষ্ট শক্তিশালী। আমরা নেগোশিয়েট করতে পারি, জাতীয় পর্যায়ের সংলাপের আয়োজন করতে পারি।

ডেইলি স্টার: আমাদের কোন ইনস্টিটিউটগুলো শক্তিশালী?

জামাল উদ্দীন: আমাকে প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি—আমাদের গণমাধ্যমগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী।

ডেইলি স্টার: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী বলবেন? শিক্ষকদের সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী বলবেন?

জামাল উদ্দীন: সব জায়গাতেই আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। প্রতিটি দেশেরই অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নতির একটি লেভেল আছে। নানা ধরনের থিউরি অনুযায়ী সমাজের মানুষেরও নানা ধরনের স্তর আছে। একজন মানুষ যে স্তরে থাকে, তিনি সেই স্তরের উন্নয়নের রিপ্রেজেন্ট করে।

আপনি যদি আমেরিকা, লন্ডন বা জাপানের বিষয়টি দেখেন, তারা একটি লেভেলে গেছে। আমরা এখনো সেই লেভেলে পৌঁছাতে পারিনি। আপনি যদি পশ্চিমাদের মানকে আদর্শ ধরেন, তাহলে আমাদের কিছুই নেই। কিন্তু যদি ভারত বা পাকিস্তানের মানকে আদর্শ ধরেন, তাহলে আমাদের অনেক কিছুই আছে।

ডেইলি স্টার: গণতান্ত্রিক কোনো দেশে কি এমন নজির আছে যে করোনা বা অন্য কোনো কারণে ২ বছর বা ৫ বছর নির্বাচন ছাড়া সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে?

জামাল উদ্দীন: কোনো দেশে নজির নেই। কিন্তু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করে আমরা নজির তৈরি করেছিলাম। কোনো দেশে নজির নেই বলে আমরা নজির তৈরি করতে পারব না, তা হয় না। আমরা শুধু আমদানি, রপ্তানি, গণতন্ত্র, নিয়ম, নীতি এগুলোই মেনে চলব, আমাদের কিছুই থাকবে না, আমাদের মাথা থেকে কিছুই আসবে না, সেটা তো হয় না।

ডেইলি স্টার: নির্বাচন ছাড়া সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নজির তৈরি করতে পারি?

জামাল উদ্দীন: সেটা তো হতেই পারে। আমরা দেখাতে পারি যে বাংলাদেশ কত শক্তিশালী। আমরা দেখাতে পারি যে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে সরকারের ও সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সহমর্মিতা, সেটাই প্রমাণ করবে।

Comments