নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাড়ছে অপতথ্য ছড়ানো

দুই হাজার ৪৯টি যাচাইকৃত ভুয়া সংবাদ পর্যালোচনার ভিত্তিতে দেখা যায়, মার্কিন ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সেপ্টেম্বরে অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে।
নির্বাচন

জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপগুলো হয়ে উঠছে গুজব, অপতথ্য ও ভুয়া খবরের কারখানা। জনমতে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী কনটেন্ট নিয়ে চলছে জোরালো প্রচারণা।

ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা ডিসমিসল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, কেবলমাত্র সেপ্টেম্বরেই ফ্যাক্টচেকাররা রাজনৈতিক অপতথ্যের অন্তত ৮৪টি ঘটনা শনাক্ত করেছেন। এই সংখ্যা জানুয়ারিতে ছিল ৩২টি।

দুই হাজার ৪৯টি যাচাইকৃত ভুয়া সংবাদ পর্যালোচনার ভিত্তিতে দেখা যায়, মার্কিন ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে সেপ্টেম্বরে অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে।

ডিসমিসল্যাবের পর্যবেক্ষণে বের হয়েছে, এসব অপতথ্যের মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সরকারপন্থি শিক্ষক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার মিথ্যা দাবি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভুয়া বিবৃতি।

কিছু ক্ষেত্রে এসব কনটেন্টের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভুয়া এবং ফ্যাক্টচেকাররা সেগুলো শনাক্ত করতে পেরেছেন। এগুলোর মধ্যে বিরাট সংখ্যক কনটেন্টে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছে এবং সাইবারস্পেসে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক দীন এম সুমন রহমান বলেন, 'বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে এক ধরনের যুদ্ধকে সামনে রেখে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে এগুলো ব্যবহার করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো কোনভাবেই অনিচ্ছাকৃত ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে না।'

অধ্যাপক সুমন সংবাদ বা তথ্য নিরীক্ষা সংস্থা ফ্যাক্টওয়াচের প্রধান।

'ভুয়া খবর' ও বিভ্রান্তিকর তথ্য আলাদা, কেননা বিভ্রান্তিকর তথ্য সাধারণত বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

'আমাদের প্রায় ৩০০ গ্রুপ আছে। এগুলোকে আমরা আমাদের প্রচারের জন্য ব্যবহার করি। এখানে সরকারের উন্নয়ন কাজের খবর প্রচার করা হয় এবং বিরোধীদের ছড়ানো ভুয়া খবরের বিষয়ে সচেতন করা হয়।'

দ্য ডেইলি স্টার গত দুই মাসে কয়েক ডজন পেজ, গ্রুপ ও মেসেজিং অ্যাপের শতাধিক পোস্ট পর্যালোচনা করে দেখেছে যে এগুলো পরিচালনাকারী কিছু 'অ্যাডমিন' নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করলেও অধিকাংশই তাদের পরিচয় গোপন রেখেছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বটের (বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য তৈরি ভুয়া প্রোফাইল) পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রোফাইল ও গ্রুপের মাধ্যমে বিএনপিবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে 'রাষ্ট্রবিরোধী' মন্তব্য সরাতে সরকারি সংস্থাগুলো কাজ করায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর 'সাইবার যোদ্ধা'রা বিদেশি ইনফ্লুয়েন্সার এবং নামহীন টেলিগ্রাম চ্যানেল ও গ্রুপ চ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

এই বিদেশি ইনফ্লুয়েন্সারদের মধ্যে আছেন কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক, যারা বিদেশ থেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

অনেকেই তাদের পেজ বা প্রোফাইল তৈরি করছেন মিডিয়া সংস্থা হিসেবে এবং ফেসবুকে সেগুলো 'নিউজ সাইট' হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এগুলোর কোনো প্রতিবেদক বা প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যায় না।

ভুয়া সংবাদ প্রচারে একটি অভিন্ন 'চতুর কৌশল' হলো অপর রাজনৈতিক দলের কর্মী সেজে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করা। এর জন্য তারা অপর দলের বা তাদের নেতাদের নামে পেজ খুলছেন এবং এরপর সেখান থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছেন।

ফাঁদে ফেলার আরেকটি কৌশল 'থার্স্ট ট্র্যাপ'। এটি হলো নারীর নামে প্রোফাইল তৈরি করে প্রথমে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে ফলোয়ার বাড়ানো এবং পরবর্তীতে এসব প্রোফাইলের মাধ্যমে গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া।

এ ধরনের অনেক প্রোফাইলের অ্যাকটিভিটি অনেকটা 'বট'র মতো। অর্থাৎ প্রোফাইল পরিচালনা করা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে, যা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে৷ এসব গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে কোনো মানুষের প্রকৃত প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন।

'বট' পরিচালিত অ্যাকাউন্ট চেনার উপায় হলো—প্রোফাইলে তথ্য অনেক কম থাকবে, প্রোফাইল ফটো হিসেবে থাকবে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা কোনো ছবি, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের বন্ধুদের আধিক্য ও লক করা প্রোফাইল।

আওয়ামীপন্থি সাইবার যোদ্ধা

গত ২৮ ও ২৯ আগস্টের মধ্যে এক ভুয়া ভিডিওতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে জাতিসংঘের সাবেক আবাসিক সমন্বয়কারী এক বিবৃতিতে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন যে কেন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভিডিওটি ৩৯টি পেজে ক্রস পোস্ট করা হয়েছিল।

ক্রস পোস্ট হলো ফেসবুকের একটি বিশেষ সুবিধা, যার মাধ্যমে একটি কনটেন্ট সমন্বিতভাবে একাধিক পেজে পোস্ট করা যায়।

এই পেজগুলোর বেশ কিছু পোস্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা টেলিভিশন, বাংলাদেশের রাজনীতি, স্পোর্টস ২৪x৭, ব্রেকিং নিউজ-লাইভসহ আরও কয়েকটি ফেসবুক পেজ সমন্বিতভাবে নানান কনটেন্ট ক্রস পোস্ট করে।

এই সবগুলো পেজ ফেসবুকে 'সংবাদমাধ্যম' হিসেবে নিবন্ধিত।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে 'ঢাকা টেলিভিশন'র কথা। এই নামে একটি ওয়েবসাইট আছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো তথ্য সেখানে নেই। এমনকি তাদের প্রকাশক বা কর্মীদের সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই।

বাংলাদেশের নিবন্ধিত টেলিভিশন চ্যানেলের তালিকায় এর অস্তিত্ব নেই, এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন তালিকায়ও তাদের সংশ্লিষ্ট নিউজ পোর্টালের অস্তিত্ব নেই। এটি নিবন্ধিত আইপিটিভিও (ইন্টারনেট প্রোটোকল টেলিভিশন) না। ওয়েবসাইটটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ক্লাউড সার্ভারের বিদেশি আইপি ঠিকানা ব্যবহার করে। যার ফলে এর স্থানীয় ঠিকানা খুঁজে বের করা অসম্ভব।

বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাস্তায় সহিংসতার একদিন পর ২৯ অক্টোবর রাত ১০টা ২৯ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিটের মধ্যে 'ঢাকা টেলিভিশন', 'ব্রেকিং নিউজ-লাইভ', 'বাংলাদেশের রাজনীতি' ও 'নিউজ আপডেট' একটি ভিডিও পোস্ট করে। 'বিএনপির অপরাধীদের বাঁচাচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার' শিরোনামে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।

ভিডিওতে দ্য ডেইলি স্টারের একটি সংবাদ প্রতিবেদনকে 'উদ্দেশ্যমূলক' হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ডেইলি স্টারের ওই প্রতিবেদনে একজন বাসচালকের সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়েছে, যার বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। চালক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, 'পুলিশ ভেস্ট' পরা দুই যুবক রাজধানীর মালিবাগ ফ্লাইওভারে বাসটিতে আগুন দিয়েছে।

পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং 'প্রেস' লেখা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে বাসে আগুন দেওয়া ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ইংরেজি পড়তে না পারা ওই বাসের চালক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দেখে সেটাকে পুলিশ ভেস্ট মনে করেছিলেন।

ঢাকা টেলিভিশন ওই ভিডিওটির মালিক এবং বাকি তিনটি ক্রস পোস্ট করা হয়েছে। প্রাথমিক পোস্টের পর ঢাকা টেলিভিশনের পেজটি সেদিন মধ্যরাতের আগে অন্তত ২৩টি ফেসবুক গ্রুপে এই ভিডিওটি পোস্ট করেছে।

ফেসবুকের অ্যাড লাইব্রেরির তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে ঢাকা টেলিভিশন তার নিজস্ব পেজসহ চারটি পেজের কনটেন্ট বুস্ট করতে ৮০০ ডলার খরচ করেছে।

কয়েক ডজন গ্রুপ পর্যালোচনা করে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পেয়েছে, শুধুমাত্র তিনজন প্রকৃত ব্যক্তি অ্যাডমিন বা মডারেটর হিসেবে আছেন।

তাদের একজন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আরিফ। তিনি ক্ষমতাসীন দলের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) যুব প্ল্যাটফর্ম ইয়াং বাংলার সদস্য।

অন্তত পাঁচটি গ্রুপের অ্যাডমিন আরিফ বলেন, 'দল থেকে সব পেজ চালানো হয় না।'

অপর অ্যাডমিন হচ্ছেন মাহমুদ বিন সাজিদ। তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দ্য ডেইলি স্টারের পর্যবেক্ষণ করা অন্তত ১২টি গ্রুপের অ্যাডমিন তিনি।

'আমরা কোনো অপপ্রচার করি না। আমরা শুধুমাত্র বিএনপির কার্যক্রম সম্প্রচার করি। আমরা কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইনও চালাচ্ছি না।'

ডেইলি স্টারকে সাজিদ বলেন, 'আমাদের প্রায় ৩০০ গ্রুপ আছে। এগুলোকে আমরা আমাদের প্রচারের জন্য ব্যবহার করি। এখানে সরকারের উন্নয়ন কাজের খবর প্রচার করা হয় এবং বিরোধীদের ছড়ানো ভুয়া খবরের বিষয়ে সচেতন করা হয়।'

ক্ষমতাসীন দলের ওয়েব টিম 'দ্য ড্রিল' নামে প্রশিক্ষণ দেয়। এখানে ব্লকিং ও কোনো পোস্ট সরিয়ে দেওয়া এবং 'ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ফাঁদ' এড়ানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর 'ফেসবুক ব্লকিং/রেস্ট্রিকশন' বিষয়ে এমনই এক কর্মশালার জন্য অংশগ্রহণকারী আহ্বান করা হয়।

সাজিদ জানান, তিনি 'দ্য ড্রিল'র মাধ্যমেই এসেছেন।

বিরোধী দলপন্থি সাইবার যোদ্ধা

নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের পরদিন গত ২৯ অক্টোবর দলটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাখা দুটি ফটোকার্ড তৈরি করেছে। সেখানে দাবি করা হয়, সাবেক সাংবাদিক নেতা রফিক ভূঁইয়া পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের আঘাতে মারা গেছেন।

আসলে, জাতীয় প্রেসক্লাবে যাওয়ার সময় রিকশা থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

ফটো কার্ডগুলো ১৩টি বিএনপিপন্থি পেজে শেয়ার করা হয়। এর মধ্যে 'বিএনপি মিডিয়া সেল'র পেজও আছে। এর মধ্যে অন্তত ছয়টিতে সমন্বিতভাবে ও কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পোস্ট করা হয়।

ফটো কার্ডগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবিশ্বাস্যভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি 'বিএনপি মিডিয়া সেল'র পোস্টটি ওই পেজের অন্যান্য পোস্টের চেয়ে নয় গুণ বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

গুজব আগুনের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়। গত রোববার ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকারবিষয়ক অ্যাডভোকেসি সেন্টার রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস এক বিবৃতিতে দাবি করেছে যে রফিক ভূঁইয়াকে পুলিশ হত্যা করেছে।

ফেসবুকের অ্যাড লাইব্রেরির তথ্যে জানা যায়, বিএনপির অফিসিয়াল দুটি পেজ গত এক বছরে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে ১৯ হাজার ৫৩১ ডলার খরচ করেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও বিএনপির প্রেস উইংয়ের প্রধান শায়রুল কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কোনো অপপ্রচার করি না। আমরা শুধুমাত্র বিএনপির কার্যক্রম সম্প্রচার করি। আমরা কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইনও চালাচ্ছি না।'

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের কয়েক ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'এক্স'-এ (সাবেক টুইটার) পোস্ট করা এক ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ শত শত বার রিটুইট করা হয়েছে।

দেশের অন্যতম পুরোনো ইসলামপন্থি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপ বাঁশেরকেল্লার পোস্টটিতে এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দুজন মানুষ রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছেন, যারা বিএনপির মহাসমাবেশে এসে মারা গেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

পোস্টের লেখাটি ছিল এমন, 'বাংলাদেশে হৃদয় বিদারক দৃশ্য। গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। স্বৈরাচারী হাসিনার নির্দেশে পুলিশ নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এই নিরীহ প্রাণগুলো কেড়ে নিয়েছে। তারা একটি বিরোধী দলের মহাসমাবেশে ভোটের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।'

নিজেদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে এক পৃথক বার্তায় প্ল্যাটফর্মটি সবাইকে ওই কনটেন্ট রিটুইট করতে বলেছে।

২৮ অক্টোবরের সমাবেশ কভার করতে দ্য ডেইলি স্টারের নয় সাংবাদিক এবং পাঁচ ফটোসাংবাদিক মাঠে ছিলেন। অন্যান্য মিডিয়া হাউসও তাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও ক্যামেরাপারসন পাঠিয়েছেন। সবমিলিয়ে কয়েক শ সাংবাদিক মাঠে ছিলেন। ডেইলি স্টারের ১৪ সাংবাদিকসহ তাদের কেউই এমন দৃশ্য দেখেননি।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বাঁশেরকেল্লা পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।

সরকারবিরোধী মনোভাব, অপতথ্য ও গুজব ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা বিএনপি সংশ্লিষ্ট কিছু ফেসবুক পেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব পেজের অধিকাংশ অ্যাডমিন দেশের বাইরে থাকেন।

'জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করছে। র‌্যাবের মনিটরিং সেল এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।'

পুলিশের মতে, বিএনপির পক্ষ থেকে সৃষ্ট প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপতথ্য বা গুজব ছড়ানো হয় দেশের বাইরে, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম ইউরোপের মতো অঞ্চল থেকে।

অপরদিকে ফেসবুকের ট্রান্সপারেন্সি ফিচারের মাধ্যমে প্রায় ৫০টি আওয়ামীপন্থি পেজ বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, এসব পেজের অ্যাডমিনদের প্রায় সবাই বাংলাদেশে অবস্থান করেন।

সরকারের উদ্যোগ

বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স (ওএসআইএনটি) পদ্ধতি ব্যবহার করে সর্বজনীন তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার সাইবারস্পেস মনিটরিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্ট ব্লক বা ফিল্টার করে। সংস্থাটির সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুসারে, রাষ্ট্রবিরোধী কনটেন্ট ঠেকাতে তারা ব্লকিং ও ফিল্টারিং পদ্ধতির ব্যবহার করে।

পুলিশের সাইবার ও বিশেষ অপরাধ বিভাগ গুজব ছড়ানোর অপরাধে গত তিন মাসেই অন্তত ৭০০ পেজ, আইডি ও গ্রুপ বন্ধ করে দেয়।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, 'জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করছে। র‌্যাবের মনিটরিং সেল এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।'

তবে দেশের বাইরে থেকে পোস্ট করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো কনটেন্ট সরিয়ে দিতে বা ব্লক করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, 'আইনি কারণে তাদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। তাই তারা ক্রমাগত গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে।'

আইন প্রয়োগকারী বাহিনীগুলোর কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে না বললেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো মূলত তাদেরকেই টার্গেট করে, যারা সরকারবিরোধী পোস্ট করে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব প্রচারণার বিষয়ে তারা অবগত আছেন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ভুয়া তথ্য ও ভুয়া খবর প্রতিরোধে নিজস্ব টিম গঠন করেছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এবারও এমন একটি টিম গঠন করতে পারে কমিশন।

গত আগস্টে ফেসবুক ও টিকটকের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ফেসবুকের সঙ্গে তাদের বৈঠক সম্পর্কে বলেছেন, 'কীভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো অপপ্রচার, বিশেষ করে বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা এবং অপতথ্য রোধ করা যায় কিংবা কীভাবে এগুলো সরিয়ে দেওয়া ও ব্লক করা যায়, সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।'

Comments