ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহাসিক ‘দারুল আদালত’

সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের পাহাড়ের চূড়ায় ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন ‘দারুল আদালত’ প্রায় ২০ বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
জরাজীর্ণ অবস্থায় চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন ‘দারুল আদালত’। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের পাহাড়ের চূড়ায় ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন 'দারুল আদালত' প্রায় ২০ বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।

কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০২ সালে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে এবং ভবনটিতে একাডেমিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

এর আগে ভবনটি কলেজ লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের কলেজ শাখার অফিস হিসেবেও ব্যবহার করা হতো।

দ্বিতল ভবনটিতে মুঘল ও পাশ্চাত্য যুগের অনন্য স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ৩ ফুট চওড়া দেয়াল ইট-চুন-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ভবনটিতে ১৬টি কক্ষের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোণে ২টি টাওয়ার রয়েছে।

টাওয়ারে পৌঁছানোর জন্য ২টি সর্পিল সিঁড়ি রয়েছে। প্রতিটি টাওয়ারে ছোট গম্বুজ থাকলেও ০.৭৭৫ একর ভবন এলাকায় কোনো টানেল পাওয়া যায়নি বলে কলেজ সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।

ভবনটির কক্ষ ও সিঁড়ির প্রবেশদ্বার সিল করে দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় ভবনটি আগাছায় ছেয়ে গেছে। ভবনের প্রায় সব জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়ছে।

সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাইমুন উদ্দিন বলেন, 'দর্শনার্থীরা প্রায়ই ভবনটি দেখতে আসেন, কিন্তু ভবনটি সিল করে দেওয়ায় তারা ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন না।'

'এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। রাষ্ট্রের উচিত এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া', তিনি বলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শনে এসে ভবনটির বেহাল দশা দেখে হতাশা প্রকাশ করেন।

তাদের একজন সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি বইয়ে ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে পড়েছেন।

সাইদুল বলেন, 'ঐতিহাসিক এই ভবনের করুণ দশা দেখে খারাপ লাগছে। ভবনটি রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।'

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্মকর্তারা ২০১৩ সালে ভবনটি পরিদর্শন করেন এবং এটিকে ঐতিহাসিক স্থান ঘোষণা করে সুরক্ষার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু এটি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জরাজীর্ণ অবস্থায় চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন ‘দারুল আদালত’। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

যোগাযোগ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, 'ভবনটি সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবনটি ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত হয়েছিল।'

তিনি বলেন, 'আমি ২০১৯ সালে আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালীন ভবনটি পরিদর্শন করেছি এবং ভবনটি রক্ষার জন্য একটি সুপারিশসহ প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম।'

'চট্টগ্রাম ছাড়া প্রতিটি বিভাগেই বিভাগীয় জাদুঘর রয়েছে। ভবনটিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় জাদুঘরে পরিণত করা যেতে পারে', যোগ করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, '২০১৩ সালে ভবনটি সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কলেজ কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখেছিল। ওই চিঠিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ভবনের জমির মালিকানা হস্তান্তর করতে বলেছে, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সরকারি জমির মালিকানা হস্তান্তর করতে পারে না।'

যোগাযোগ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান জানান, তিনি সম্প্রতি অফিসে যোগদান করেছেন এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না।

তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত আমি জানি, ভবনটি রক্ষা করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমি জানবো।'

ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব

স্থানীয়রা এই ভবনটিকে 'পর্তুগিজ ভবন' হিসেবে চেনেন। লোককাহিনী মতে, ভবনটি পর্তুগিজ জলদস্যুরা তৈরি করেছিল। এর নীচে একটি সুড়ঙ্গ ছিল, যা কর্ণফুলী নদীকে সংযুক্ত করেছিল। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে জলদস্যুরা গোপনে যাতায়াত করতো। ভবনের শীর্ষে থাকা ২টি টাওয়ার থেকে তারা চারদিকে নজরদারি করতো।

তবে ইতিহাসবিদরা এই লোককাহিনীর সত্যতা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে, ভবনটি ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত।

ইতিহাসবিদ আব্দুল হক চৌধুরী তার 'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' গ্রন্থে বলেছেন, ব্রিটিশরা ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম দখল করার পরপরই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল।

'ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে তারা তাদের আদালত স্থাপনের জন্য ভবনটি নির্মাণ করেছিল। মুঘল ও পশ্চিমা বৈশিষ্ট্যে নির্মিত দোতলা ভবনটিতে দুটি টাওয়ার ছিল এবং প্রতিটি টাওয়ারে একটি করে গম্বুজ ছিল যেখান থেকে ব্রিটিশ প্রহরীরা বাইনোকুলার দিয়ে কর্ণফুলী নদী ও সমুদ্রে জাহাজ চলাচল পর্যবেক্ষণ করতো', বলেন আব্দুল হক চৌধুরী।

তিনি জানান, ১৮৫৭ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসকরা চট্টগ্রামের লালদীঘির পাশে লালকুঠিতে (লাল বিল্ডিং) আদালত স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ভবনটি আদালত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

Comments