চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ

‘ইমেজ’ সংকটে ডিবি, ঝিমিয়ে চলছে কার্যক্রম

ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কার্যালয়ের অবস্থানগত (লোকেশন) সমস্যা এবং অপরাধের ধরন পরিবর্তনের কারণে আগের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন তারা।

ঝিমিয়ে চলছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যক্রম। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও মামলার তদন্তে পিছিয়ে থাকা, তদন্তে অনীহা, লোক দেখানো কার্যক্রম ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাবে 'ইমেজ' সংকটে পড়েছে নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।

এ ছাড়াও আছে উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবলদের মধ্যে হতাশা। এক সময় বন্দরনগরীর গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোয় ডিবির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও, গত এক বছর অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে পুলিশের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি।

ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কার্যালয়ের অবস্থানগত (লোকেশন) সমস্যা এবং অপরাধের ধরন পরিবর্তনের কারণে আগের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন তারা।

দক্ষ কর্মকর্তার অভাব থাকায় অপরাধ তদন্তে ও অপরাধী শনাক্তে সফলতা আসছে না। ফলে র‍্যাব ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সেই 'সুযোগ'টি নিচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।

২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর বন্দরটিলা বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় ৫ বছর বয়সী আয়াত। তারপর নানান জায়গায় খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ইপিজেড থানায় জিডি করে তার পরিবার।

শিশু আয়াতের নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনে থানা পুলিশ ব্যর্থ হলে, ছায়া তদন্তে নেমে আসামি শনাক্ত করে পিবিআই। পরে ৩০ নভেম্বর আয়াতের দেহের খণ্ডিত অংশ খাল থেকে উদ্ধার করে পিবিআই, যা সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

এ ছাড়া, গত ৪ মার্চ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একজনের মরদেহ উদ্ধার করে খুলশী থানা পুলিশ। থানা পুলিশ আসামি শনাক্তে ব্যর্থ হলেও, পিবিআই আসামি গ্রেপ্তার করে।

সিএমপির ডিবি পুলিশ বর্তমানে ২ জোনে বিভক্ত। বন্দর ও পশ্চিম মিলে ডিবির এক জোন এবং দক্ষিণ ও উত্তর মিলে অপর জোন। এই ২ জোনের দায়িত্বে আছেন ২ উপপুলিশ কমিশনার।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিবির বন্দর জোনে মামলা হয়েছে ২১২টি। অন্যদিকে ডিবির উত্তর জোনে মামলা হয়েছে ২০৯টি।

২ জোনের মধ্যে আলোচিত ঘটনা ছিল শুধু বন্দর জোনের। ২ রোহিঙ্গাসহ নির্বাচন কমিশনের ৫ অস্থায়ী ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে ভোটার তালিকা জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল বন্দর জোন ডিবি।

সিএমপির তথ্য অনুসারে, ডিবির উত্তর বিভাগে ৫ টিমের মধ্যে ডিসি, এডিসিসহ সদস্য আছেন প্রায় ৬৪ জন। তাদের মধ্যে পরিদর্শক ৬, এসআই ১১, এএসআই ১৭ ও কনস্টেবল ৩০ জন। তাদের ব্যবহারের জন্য আছে ৪ গাড়ি, যদিও এর একটি পুরোনো।

অন্যদিকে, বন্দর জোনের সদস্য ৭০ জন। তাদের মধ্যে পরিদর্শক ৬, এসআই ৭, এএসআই ১৮ ও বাকিরা কনস্টেবল। ৫টি গাড়ি ব্যবহার করে এই জোনে টহল ও অভিযান পরিচালনা করা হয়।

সিএমপির ডিবিতে কর্মরত এবং নগর পুলিশের অন্যান্য পদের ১০ জনের বেশি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ডিবি পুলিশের কাজের পরিধি অনেক থাকলেও, সংস্থাটি এখন আলোচনায় নেই বললেই চলে।

তারা বলছেন, মাদক উদ্ধার ও ছোট অপরাধী আটক করেই ডিবি রুটিন দায়িত্ব পালন করছে। অথচ দিনদিন শহরের পরিধি বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে অপরাধও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবি পুলিশ থেকে বদলি হয়ে নগর পুলিশের দক্ষিণ বিভাগে কর্মরত এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিবিতে অফিসার সংকট। যারা এখন আছেন তারা প্রায় সবাই নতুন। তারা শহরের অলি-গলি কম চেনেন। এখানে সোর্স মেইনটেইনের বিষয় আছে, যা নতুন কাউকে তৈরি করতে অনেক সময় লাগে।'

তার মতে, 'এ ছাড়া কাজের জন্য নিজেদের মধ্যে তাগাদা নেই অনেকের। অনেকেই অপেক্ষা করছেন ডিবিতে কিছু সময় কাটিয়ে থানায় পদায়ন হওয়ার জন্য।'

ডিবির বন্দর জোনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহরে যে অপরাধ হচ্ছে না, বিষয়টা এমন না। আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। আমাদের দক্ষ জনবল নেই। অনেকেই ট্রেনিং নিয়ে অন্য ইউনিটে চলে যাচ্ছেন বা যেতে হচ্ছে। এ ছাড়া টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা আছে। কাজ করলে অনেক সমস্যা, তাই না করে থাকাই ভালো—এমন মনোভাব নিয়ে চলছে ডিবি।'

'এখন টুকটাক যা মাদক উদ্ধার হয়, তা শুধু অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে দেখানোর জন্য। বিশদভাবে তদন্ত করে লেগে থেকে কাজ করার আগের দিন বা অফিসার এখন নেই,' যোগ করেন তিনি।

তবে এসব অভিযোগ নাকচ করে ডিবির (বন্দর-পশ্চিম) উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আলী হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের জনবল সংকট আছে এটা ঠিক। আগে ১২টি টিম ছিল, এখন আছে ৫টি। শহর অনেক বড়। এ ছাড়া টেকনিক্যাল ইস্যু আছে। অন্যদিকে আমাদের অফিস এখন নতুন জায়গায়। আগে মানুষ অফিসে আসত, এখন আসে না। অপরাধের ধরনও পাল্টে গেছে। তবে আমরা কাজ করছি। প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে আমরা ভালো কিছু করে নিজেদের প্রমাণ করব।'

তিনি আরও বলেন, 'এখন মামলা তদন্ত করেন এসআই ও ইনস্পেক্টররা। এএসআইরা শুধু রুটিন ডিউটি পালন করেন। একইসঙ্গে মামলা তদন্ত, অভিযান ও অন্য কাজ করা এসআই ও ইন্সপেক্টরদের জন্য একটু চাপের।'

ডিবির উত্তর জোনের ডিসি নাহিদ আদনান তাইয়ান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের অফিসার নতুন হলেও তারা ভালো কাজ করছেন। তবে আরও ভালো করার জন্য সবাই একসঙ্গে কাজ করছি।'

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এ এস এম মাহতাব উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দায়িত্ব নিয়েছি ৭ মাসের মতো। এই সময়ে ডিবির ভালো কিছু কাজ আছে। এটা ঠিক যে প্রযুক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতা ও জনবল সংকট আছে। ডিবিতে এসি, এডিসি ও ইনস্পেক্টর সংকট আছে। জনবল সংকট থাকার পরও কীভাবে আরও গতিশীল করা যায়, তা আমরা মনিটর করছি।'

Comments