নবনির্মিত শহীদ মিনার নিয়ে অসন্তোষ, ১৬ ডিসেম্বর শ্রদ্ধা নিবেদন অস্থায়ী শহীদ মিনারে

তাদের অভিযোগ, শহীদ মিনারের নতুন রূপ চট্টগ্রামবাসীকে হতাশ করেছে।
চট্টগ্রামে নবনির্মিত শহীদ মিনার
চট্টগ্রামে নবনির্মিত শহীদ মিনার। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

চট্টগ্রামে নবনির্মিত শহীদ মিনার সড়ক থেকে দেখা না যাওয়ায়, এর প্রতিবাদে এ বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্দরনগরীর সুশীল সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মীরা।

তাদের অভিযোগ, শহীদ মিনারের নতুন রূপ চট্টগ্রামবাসীকে হতাশ করেছে। নন্দনকানন এলাকার কেসি দে রোডের পাশে টিলার ওপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশে আগে সবুজ গাছপালা ছিল। কিন্তু নবনির্মিত শহীদ মিনারের চারপাশে সবুজের পরিবর্তে এটিকে কংক্রিটে আচ্ছাদিত করা হয়েছে।

মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের সঙ্গে শহীদ মিনারের সংযোগ স্থাপনে ২১ ফুট উঁচু ওভারপাস নির্মাণ করায়, সড়ক থেকে নবনির্মিত শহীদ মিনারটি ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। শ্রমিকরা শহীদ মিনারের পেছনের দেয়ালে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস চিত্রিত পোড়ামাটির শিল্পকর্ম বসাচ্ছিলেন।

চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম ইনস্টিটিউট একই জায়গায় অবস্থিত। প্রথমটি রাস্তার একপাশে টিলার ওপর এবং অন্য দুটি রাস্তার অপর পাশে একই কমপ্লেক্সের মধ্যে ছিল।

জানা যায়, মুসলিম ইনস্টিটিউট হলটি ১৯২৫ সালে একদল সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মীরা স্থাপন করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে সরকার হলটি অধিগ্রহণ করে।

অন্যদিকে, ১৯৬৩ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউটে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে পাবলিক লাইব্রেরি। পরবর্তীতে ১৯৯০ এর দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের পাশে লাইব্রেরির জন্য একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়।

মুসলিম ইনস্টিটিউট আধুনিকায়ন ও পাবলিক লাইব্রেরি সম্প্রসারণের জন্য সংস্কৃতিকর্মী ও সুশীল সমাজের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে এই এলাকায় একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে।

২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় পুরোনো মুসলিম ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি ও শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়।

চট্টগ্রাম পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মুসলিম ইনস্টিটিউটের জায়গায় ৮ তলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৯০০ আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম, ৩৫০ আসন বিশিষ্ট মিনি অডিটোরিয়াম, দুটি সেমিনার কক্ষ, একটি আর্ট গ্যালারি ও একটি স্যুভেনির শপ।

তিনি আরও জানান, পুরোনো পাবলিক লাইব্রেরির জায়গায় একটি ১৫ তলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। লাইব্রেরির ৯টি রিডিং হলে একসঙ্গে দের হাজার পাঠক বসতে পারবেন।

এছাড়া, সেখানে দুটি সেমিনার হল নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে একটি রেস্ট হাউস, একটি ডরমেটরি ও একটি আইসিটি লাইব্রেরিও নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।

তিনি বলেন, 'একই প্রকল্পের অধীনে আগের অবয়ব অপরিবর্তিত রেখে পুরোনো শহীদ মিনারের জায়গায় একটি নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের জুনে প্রকল্পটি শেষ হবে।'

গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন।

২০১৮ সালে পুরোনো শহীদ মিনারটি অপসারণের পর প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে নগরীর সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন।

নতুন শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় এ বছর ১৬ ডিসেম্বর নবনির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর কথা ছিল।

সম্প্রতি সাংস্কৃতিক কর্মী ও সুশীল সমাজের সদস্যরা নবনির্মিত শহীদ মিনার পরিদর্শনে যান। কিন্তু, চারদিকে কংক্রিটের কাঠামোর কারণে শহীদ মিনারটি রাস্তা থেকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, এমন অভিযোগ তুলে তারা নবনির্মিত শহীদ মিনারের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। 

এ অবস্থায় ২ ডিসেম্বর সাংস্কৃতিক কর্মী, সুশীল সমাজের সদস্য ও নগরবাসী নবনির্মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি সভা করেন। সভায় ১৬ ডিসেম্বর নবনির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন না করে অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।

তারা শহীদ মিনারের সামনের ওভারপাস ও চারপাশের দেয়াল ভেঙে ফেলার দাবি জানান, যেন সড়ক থেকে শহীদ মিনারটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

সভায় কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, 'এখানে তিনটি স্থাপনা যুক্ত হয়েছে, শহীদ মিনার, পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম হল। তিনটি স্থাপনার মধ্যে শহীদ মিনারের আবেগ ও প্রভাব ভিন্ন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হওয়ার কথা ছিল শহীদ মিনার। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'এখানে একটা করপোরেট শহীদ মিনার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা গণমানুষের শহীদ মিনার চাই। সামনের স্থাপনা ভেঙে ফেললে আমার মনে হয় একটা সমাধান হতে পারে।'

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওভারপাস ভেঙে দিলে ভালো হবে। রাস্তার একপাশে মুসলিম ইনস্টিটিউট ও পাবলিক লাইব্রেরি থাকবে, অন্য পাশে থাকবে শহীদ মিনার। তাহলে আর কেউ আপত্তি করবে না।'

যোগাযোগ করা হলে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহীদ মিনারকে রাস্তা থেকে দৃশ্যমান হতে হবে। ওভারপাসটি অপসারণ করা দরকার। কারণ এটি শহীদ মিনারকে ঢেকে ফেলেছে। স্থপতি ও প্রকৌশলীরা একসঙ্গে বসলে এটা ঠিক করা অসম্ভব কিছু নয়।'

এ দাবির বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, 'যদি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কাঠামোগত নকশা সংশোধন করার কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়, তাহলে সেটি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।'

Comments