বেনিস্টার ইফেক্ট: অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছিল যেভাবে

রজার বেনিস্টার ১৯৫৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৌঁড় প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে এক মাইল দৌঁড়াতে সময় নেন ৩ মিনিট ৫৯ দশমিক ৪ সেকেন্ড। যা পূর্বে প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো। ছবি: এপি

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি গবেষণায় বলা হয়, মানুষের শারীরিক গঠনের কারণে বেশ কিছু কাজ মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব। এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন মেডিকেলের শিক্ষার্থী রজার বেনিস্টার।

১৯৫৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৌঁড় প্রতিযোগীতায় অংশ নেন তিনি। এক মাইল দৌঁড়াতে সময় নেন ৩ মিনিট ৫৯ দশমিক ৪ সেকেন্ড।

১৮৮৬ সাল থেকেই দৌঁড়বিদরা চেয়েছিলেন ৪ মিনিটে এক মাইল দৌঁড়ানোর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে। কিন্তু পেশাদার দৌঁড়বিদ না হয়েও বেনিস্টার এই রেকর্ড করেন শুধু কয়েক বছরের পরিশ্রম আর 'এটি করা সম্ভব' এই বিশ্বাস নিয়ে।

তিনি যখন তার এই ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন, তখন ডাক্তার, কোচসহ আশপাশের সবাই বলেছিলেন, এটি মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি দেখিয়েছিলেন এটি করা সম্ভব। কেবল ৪ মিনিটের কম সময়ে এক মাইল দৌঁড়ানোর রেকর্ডই করেননি, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে ভেঙেছিলেন বদ্ধমূল ধারণা।

আমেরিকার একটি বিখ্যাত মাসিক বিজনেস ম্যাগাজিন ফাস্ট কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল টেইলর লিখেন, 'বিশেষজ্ঞরা বেশ লম্বা সময় ধরে বিশ্বাস করতেন, ৪ মিনিটের মধ্যে এক মাইল দৌঁড়ানোর বাধা ভাঙতে একটি আদর্শ চলমান অবস্থা প্রয়োজন।

তারা শর্ত রাখেন, প্রথমত, তাপমাত্রা হতে হবে ৬৮ ডিগ্রী ও বাতাসহীন। দ্বিতীয়ত, দৌঁড়ের ট্র্যাকটা হতে হবে শক্ত ও শুকনো অর্থাৎ কাদা মাটি ছাড়া। তৃতীয়ত, থাকতে হবে বিশাল উচ্ছ্বসিত দর্শক সারি যারা সর্বকালের সেরা পারফরম্যান্সের জন্য দৌঁড়বিদকে আহ্বান জানাবে।

কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৬ মে রজার বেনিস্টারের জন্য এর কোনটিই পক্ষে কাজ করেনি। বরং দিনটি ছিল ঠাণ্ডা, ট্র্যাকটি ছিল ভেজা এবং ভিড় ছিল কম। মানুষ ছিল প্রায় ১ হাজারের মতো। সর্বোপরি বেনিস্টাকে দেখে মনেই হয়নি যে এই রকম বাধা ভাঙতে পারার মতো কোনো দৌঁড়বিদ। কারণ মেডিকেলের ছাত্র হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই পড়াশোনায় কাটাতেন। প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণের জন্য খুব কম সময় পেতেন। প্রতিদিন মাইলের পর মাইল স্প্রিন্টেও দৌঁড়াননি।

সেদিন যারা দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তারা সেই সময়ের পেশাদার, নিয়মিত অনুশীলনকারী এবং নিজেদের কোচের আজ্ঞাবহ। তবুও তাদের টপকে রজার বেনিস্টারের প্রথম হওয়ার কারণ ছিল তারা শুধু অনুশীলন করেছিল। আর রজার বেনিস্টার শুধু অনুশীলনই করেননি, মস্তিষ্ককেই একটি ইতিবাচক নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। বলা হয় রজার বেনিস্টারের জয় মনস্তাত্ত্বিক। এর সঙ্গে দৌঁড়ের কৌশল আর পরিশ্রম এগিয়ে দিয়েছিল মানসিক দৃঢ়তাকে৷ অর্থাৎ চাইলেই সম্ভব এই বিশ্বাস আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি।

এত বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় যা সম্ভব হচ্ছিল না, এরপর সেটি সম্ভব হওয়ার রেকর্ডটিও টিকেছিল মাত্র ৪৬ দিন। এরপরই একজন সেই রেকর্ড টপকান। এর ৪ বছরের মধ্যেই আরও ২০ জন ৪ মিনিটের কম সময়ে এক মাইল দৌঁড়াতে সক্ষম হন।

বিজ্ঞানে তার এই ধারণাকে বেনিস্টার ইফেক্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর রজার বেনিস্টার পরবর্তীতে হয়েছিলেন একজন নিউরো স্পেশালিস্ট।

বেনিস্টার ইফেক্ট হলো একজন ব্যক্তির দ্বারা করা কোনো কাজ যা অন্যদের দেখায় 'এটি করা যেতে পারে' এবং 'এটিও করা সম্ভব'। এই ধারণায় বিশ্বাস করতে ও সেটা অর্জন করতে প্রভাবিত করে।

প্রকৃতিতে অনেক কিছুই আছে যা প্রথমে অসম্ভব বলে মনে হয়। কারণ কাউকে কাজটা কখনো করতে দেখা যায়নি এবং বিশ্বাস করা হয় এটি করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি কোনোভাবে সেটা একবার করে ফেলে তখন এটি অসম্ভব মনে করা সকলেই বিশ্বাস করা শুরু করে 'এটি সম্ভব'। কোনো কাজ ততক্ষণই অসম্ভব যতক্ষণ না কাজটি করা হয়েছে। একজন কাজটা করার পর অন্যদের চিন্তা 'অসম্ভব' থেকে 'সম্ভব' এর দিকে মোড় নেয়।

সহজ কথায়, কোনো কিছুকে অসম্ভব মনে করা হয় যতক্ষণ না মানসিক প্রতিবন্ধকতা ও বদ্ধমূল ধারণার প্রভাব কাটিয়ে কেউ বিশ্বাস করছে এই কাজটা করা যাবে। মস্তিষ্ক যখন এই ইতিবাচক ইচ্ছাশক্তির সংকেত পায়, তখন শরীর ও মন সেভাবেই কাজ করে।

ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে মানসিক দৃঢ়তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রাণপ্রাচুর্য অর্থাৎ মনের ইচ্ছাশক্তি ব্যয় করতে হয় সঠিক মনোভাবের পেছনে। এছাড়াও ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে নিয়ামক হিসেবে আরও কিছু বিষয় ভূমিকা পালন করে-

মেডিটেশন বা ধ্যান

মেডিটেশনকে বলা হয় মনের সার্বজনীন ব্যায়াম। নিজের মস্তিস্ককে নিজেই নির্দেশনা দেওয়া মেডিটেশনের কাজ। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ধ্যানমগ্ন থাকলে কিছুদিন পর যে কোনো কাজে মনোনিবেশ করা সহজ হয়। নিয়মিত মেডিটেশনে মানসিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও ইচ্ছাশক্তি বাড়ে। কমে মানসিক চাপ।

পরিমিত শর্করা খাদ্য

খাদ্য থেকে শরীর গ্লুকোজ উৎপাদন করে থাকে। এটি রক্তের সঙ্গে মিশে মস্তিষ্কে যায় এবং চিন্তা, বুদ্ধি, কর্মোদ্দীপনা আর ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে সেটাও হতে হবে পরিমিত। যাতে রক্তে চিনির বা গ্লুকোজের স্বল্পতা কিংবা আধিক্য না হয়।

কাজে মনোনিবেশ

একটি কাজ করার সময় সেই কাজটির প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করতে হবে। একসঙ্গে একাধিক কাজ হাতে না নিয়ে একটি একটি করে শেষ করা। এটি মনকে কেন্দ্রীভূত করতে মস্তিষ্ককে সাহায্য করে।

পর্যাপ্ত ঘুম

ঘুম ঠিকমত না হলে এর প্রভাব পড়ে শরীরে ও মনে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্ক সঠিক ভাবে এর কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারেনা।

মানব মস্তিষ্ক এক জটিল যন্ত্র। মন ও মস্তিষ্ক একেকজনের জন্য একেকরকম ভাবে কাজ করে।
যে কেউ বেনিস্টার প্রভাব তৈরি করে অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে পারে। অপূর্ণতাকে পৌঁছাতে পারে পূর্ণতায়, আর তৈরি করে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হাজারো গল্প।

Comments

The Daily Star  | English

NBR officials end strike after govt warning

Following a stern government warning and mounting pressure from the country’s top business leaders, officials of the National Board of Revenue have withdrawn their shutdown.

3h ago