ঘুমের মধ্যে ‘বোবায় ধরে’ কেন, পরিত্রাণে করণীয়

ঘুমের মধ্যে অনেক সময় শরীরের ওপর ভারী কিছু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অনুভূত হয়। এ সময় হাত-পা নাড়ানো যায় না। এ সময় সাহায্যের দরকার পড়ে। কিন্তু, চাইবে কী করে? এ সময় মুখ থেকে কোনো কথাও বেরোয় না। কয়েক সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া এই অচলাবস্থায় মনে হয় এই বুঝি দমবন্ধ হয়ে গেল।
ছবি। এএফপি

ঘুমের মধ্যে অনেক সময় শরীরের ওপর ভারী কিছু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অনুভূত হয়। এ সময় হাত-পা নাড়ানো যায় না, সাহায্যের দরকার পড়ে। কিন্তু, চাইবে কী করে? এ সময় মুখ থেকে কোনো কথাও বেরোয় না।

এমন অসহায় অবস্থার কয়েক সেকেন্ড যেন কয়েক ঘণ্টা মনে হয়। মনে হয় এই বুঝি দমবন্ধ হয়ে গেল। যেসব মানুষ ঘনঘন এই সমস্যায় পড়েন তাদের কাছে ঘুম হয়ে যায় আতঙ্কের ব্যাপার। প্রচলিত বাংলায় এই অবস্থাকে 'বোবায় ধরা' বলা হয়। তবে এ সময় কোনো কিছুই আমাদের ধরে না বা চেপে বসে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাকে বলেন 'স্লিপ প্যারালাইসিস'।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম একজন সাধারণ মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু, এই ঘুম যদি হয় কোনো ব্যক্তির আতঙ্কের কারণ, তবে তা শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর।

স্লিপ প্যারালাইসিস কী

স্লিপ প্যারালাইসিস ঘুম এবং জাগরণের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান যা ঘুমানোর মুহূর্তে অথবা ঘুম থেকে জেগে উঠার আগমুহূর্তে হতে পারে। এ সময় একজন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রচণ্ড ভয়ের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান। স্লিপ প্যারালাইসিসে ঘরের ভেতরে কারো অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি, শব্দ শুনতে পাওয়া, বিছানা থেকে টেনে আনা বা উড়ে যাওয়ার অনুভূতি বা অসাড়তা অনুভব হয়।

১৭৮১ সালে হেনরি ফুশেল অঙ্কিত 'দ্য নাইটমেয়ার' ছবিটি দেখলে স্লিপ প্যারালাইসিসে একজন ঘুমের মধ্যে কেমন বোধ করেন তার ধারণা পাওয়া যায়। এক সময় একে অশুভ আত্মার আগমন হিসেবে ভাবা হতো যা সিনেমাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মিশরে স্লিপ প্যারালাইসিসকে ভয়ঙ্কর 'জ্বিন'-এর আক্রমণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।

স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে কম্বোডিয়ানদের প্রচলিত ধারণা, এর মাধ্যমে মৃত আত্মীয়দের কাছ থেকে বিপজ্জনক সাক্ষাৎ লাভ হয়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে প্রচুর লোকগাথা আছে।

স্লিপ প্যারালাইসিস কেন হয়

স্লিপ প্যারালাইসিসের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব এবং অনিয়মিত ঘুমের কারণে স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রভাবক আছে যেগুলোকে স্লিপ প্যারালাইসিসের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। প্রতিদিন একই সময়ে না ঘুমানো, দুশ্চিন্তা, ঘুমের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সমস্যা যেমন: হাত পায়ের মাংসপেশিতে খিচুনি, অনিদ্রা, বিষণ্নতা ইত্যাদি কারণে স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে।

২০১১ সালে পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৭ দশমিক ৬ ভাগ মানুষ স্লিপ প্যারালাইসিসে ভোগেন। বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যক্তিদের শতকরা প্রায় ৩২ ভাগের ভেতরেই এই সমস্যা দেখা যায়। মস্তিষ্কে ২ ধরনের রাসায়নিকের নিঃসরণের কারণে মাংসপেশি অসাড় হয়ে পড়ে। এর ফলে ব্যক্তির মস্তিষ্ক ঘুমের সময় সচল থাকলেও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতে পারে না, এমনটাই বলছেন কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. প্যাট্রিসিয়া এল ব্রুকস এবং ড. জন এইচ পিভার। রাসায়নিক দুটি হলো, গ্লাইসিন এবং গামা অ্যামাইনোবিউটিরিক অ্যাসিড-গ্যাবা।

স্লিপ প্যারালাইসিস কাদের হয়

স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। এমন সমস্যা যেকোনো বয়সী ব্যক্তির সঙ্গেই ঘটতে পারে। তবে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা এনএইএস বলছে, তরুণ এবং কিশোর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি এতে আক্রান্ত হয়।

মায়ো ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, ১০-২৫ বছর বয়সীদের ভেতর স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যাটি বেশি দেখা যায়। বিভিন্ন নিদ্রাজনিত রোগে আক্রান্তদের বেলায় এর হার বেশি বলে নিউইয়র্কের মন্টেফিওর হেলথ সিস্টেমের চিকিৎসক ডা. শেলবি হ্যারিস উল্লেখ করেছেন।

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল ডেনিস ৮৬২ জন ভাই-বোনের মধ্যে চালানো গবেষণায় দেখিয়েছেন স্লিপ প্যারালাইসিসে বংশগতির সংযোগ রয়েছে।

প্রতিকার

স্লিপ প্যারালাইসিস গুরুতর কোনো রোগ নয়। তবে তা ব্যক্তিকে অল্প সময়ের জন্য হলেও আতঙ্কিত ও দুর্বল করে দেয়। জীবনযাপনের সাধারণ কিছু অভ্যাসে পরিবর্তন আনলেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। যেমন:

● রাতে অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।

● প্রতি রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা। এই অভ্যাস ছুটির দিনেও বহাল রাখতে হবে।

● শোবার ঘরে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা যাতে ঘুম গভীর হয় এবং ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে।

● ঘুম পেলে টেলিভিশন বা অন্য কোনো ডিভাইস থেকে দূরে থাকা। হাতের কাছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ অর্থাৎ ঘুমের বাধা হতে পারে এমন কোন বস্তু না রাখা।

● দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করা এবং দিনে লম্বা ঘুম না ঘুমানো।

● স্লিপ প্যারালাইসিস হলে নিজেকে বোঝাতে হবে যে ভয়ের কিছু নেই, কিছুক্ষণ পর এই অবস্থা কেটে যাবে। এই সময়ে শরীর অহেতুক নাড়াচাড়া করার চেষ্টা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

তথ্যসূত্র:

বিবিসি, স্লিপ ফাউন্ডেশন

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago