বোবায় ধরা কী, কেন হয় ও সমাধানের উপায়

বোবায় ধরা
ছবি: সংগৃহীত

বোবায় ধরা অনেকের জন্যই ভয় আর আতঙ্কের নাম। তবে সত্যিকার অর্থে বোবায় ধরা বলতে কিছু নেই। আমাদের দেশে যে সমস্যাটি বোবায় ধরা নামে পরিচিত সেটি আসলে স্লিপ প্যারালাইসিস।

এটি কী, কেন হয় এবং কীভাবে এর সমাধান করা সম্ভব জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড-নেক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল হক নিপুনের কাছ থেকে।

বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস কী

ডা. হাসানুল হক বলেন, বোবায় ধরার সঙ্গে ভূতে ধরা, জ্বিনে ধরাসহ বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাসী অনেকে মানুষ। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। বোবায় ধরা সমস্যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত।

স্লিপ প্যারালাইসিস ঘুমন্ত অবস্থা ও জাগরণের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। এটি ঘুমানোর মুহূর্তে অথবা ঘুম থেকে জেগে উঠার আগ মুহূর্তে হতে পারে। বোবায় ধরা ব্যক্তি প্রায়ই একটি ভয়ের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান। ভয়ের কোনো দৃশ্য দেখতে পান। যেমন- ঘরের ভেতর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বস্তু বা প্রাণীর উপস্থিতি টের পান। সেই মুহূর্তে ওই ব্যক্তি নড়তে পারেন না।

ঘুমের বিভিন্ন স্তর আছে যেমন নন রেম স্লিপ ও রেম স্লিপ অর্থাৎ রেপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ। বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস রেম স্লিপ বিঘ্ন ঘটার কারণেই হয়ে থাকে।

বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসের সঙ্গে কিছু মানসিক রোগ যেমন- নারকোলিপসি, মাইগ্রেন, উদ্বেগমূলক ব্যাধি ও অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় যোগসূত্র রয়েছে। স্লিপ প্যারালাইসিস সাধারণত স্নায়বিক রোগ বা নারকোলিপসির কারণে হতে পারে।

তবে এসব মানসিক রোগ না থাকলেও একজন ব্যক্তির স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে বলে জানান ডা. হাসানুল হক।

বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসের কারণ

স্লিপ প্যারালাইসিসের কারণ হিসেবে ডা. হাসানুল হক বলেন, 'মস্তিষ্কে দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে গ্লাইসিন ও গামা অ্যামাইনোবিউটিরিক অ্যাসিড। এই দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বা অ্যামাইনো অ্যাসিডের নিঃসরণের ফলে মাংসপেশী অসাড় হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থ দুটি মস্তিষ্কে পেশী সক্রিয় রাখার কোষগুলোকে সুইচ অফ করে দেয়। যখন সুইচ অফ করে দেয় তখনই স্লিপ প্যারালাইসিস শুরু হয়।

ঘুমের চূড়ান্ত পর্যায় রেম স্লিপের সময় চোখ খুব দ্রুত নড়াচড়া করে। মস্তিষ্কের সংবেদনশীল অংশ রেপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ থেকে তাড়াতাড়ি আগেই বেরিয়ে আসে, একজন ব্যক্তি তখন জেগে উঠেন। কিন্তু মস্তিষ্কের নিচের অংশটি যদি তখনও রেপিড স্লিপ মুভমেন্টে থাকে তখন পেশীগুলোকে অবশ করার জন্য নিউরোট্রান্সমিটার পাঠাতে থাকে।

স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্স শরীরকে নড়াচড়া করার সংকেত পাঠায়। পেশীগুলো অবশ হয়ে থাকে। তাই মস্তিষ্ক কোনো প্রতিক্রিয়া সংকেত পায় না। তখন মস্তিষ্ক চিন্তা করতে থাকে, কেন পেশীগুলো নড়াচড়া করতে পারছে না। কাল্পনিক একটা ব্যাখ্যা মস্তিষ্ক নিজে নিজে তৈরি করে। স্বাভাবিক জাগ্রত ও স্বপ্ন চেতনা মিশে কাল্পনিক ব্যাখ্যা ও ভয়ংকর হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। বুকের ওপর কেউ চেপে ধরেছে, শরীরে কোনো প্রাণী ভর করেছে এরকম বিভিন্ন ধরনের হ্যালুসিনেশন হতে পারে। এটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে।

স্লিপ প্যারালাইসিসের লক্ষণ

১. প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জাগরণের সময় নড়াচড়া বা কথা বলতে না পারা।

২. স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় ফিসফিস, গর্জন, ভয়েস এবং গুঞ্জনের মতো শব্দ শোনা বা কল্পনা করা।

৩. বুকের ওপর চাপ অনুভব করা।

৪. শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।

৫. কারো কারো হৃদস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়।

৬. তীব্র আতঙ্ক, অত্যাধিক ভয়ের অনুভূতি ও ঘাম হওয়া।

৭. অতিপ্রাকৃত কোন প্রাণী বা ব্যক্তি শ্বাসরোধ করছে এমন অনুভূতি হওয়া।

৮. আশপাশে এমন কোনো ব্যক্তি বা বস্তু আছে তার ক্ষতি করতে চায় এমন ভয়ের অনুভূতি হওয়া।

স্লিপ প্যারালাইসিস কাদের বেশি হয়

১. ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে স্লিপ প্যারালাইসিস বেশি দেখা যায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি কম দেখা যায়।

২. অতিরিক্ত ধূমপান ও মদপানে আসক্ত যারা।

৩. ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত যারা।

৪. যারা অবসাদগ্রস্ত থাকেন।

৫. যাদের ঘুম কম হয়, ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত।

৬. অত্যন্ত ক্লান্ত থাকেন যারা তাদেরও হতে পারে।

৭. পরিবারে কারো স্লিপ প্যারালাইসিস থাকলে।

৮. অনিদ্রা, ছাড়া ছাড়া ঘুম হওয়া, ঘুমের সময়সূচি যাদের ঠিক থাকে না।

৯. বাম বা ডান কাত হয়ে শুয়ে চিৎ হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস যাদের, তাদের স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে।

১০. প্যানিক ডিসঅর্ডার থাকলে।

স্লিপ প্যারালাইসিসের চিকিৎসা

ডা. হাসানুল হক বলেন, স্লিপ প্যারালাইসিস কদাচিৎ হয়। কারো ছয় মাসে একবার, আবার কারো বছরে একবার হয়। যদি কারো ঘনঘন হয়, সপ্তাহে দুই-তিন বার বা প্রতিদিন ঘুমের সময়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্লিপ প্যারালাইসসিস সমস্যার জন্য নিউরোলজিস্ট ও অটোলারিংগোলজিস্ট, হেড নেক সার্জনদের কাছে যেতে হবে।

চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে কাউন্সিলিং করতে হবে। বোঝাতে হবে সমস্যাগুলো, যে কারণে রোগটা হচ্ছে। অ্যালকোহল, ধূমপান পরিহার করতে হবে। ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, উদ্বেগ, মানসিক অশান্তি ও ঘুমের সমস্যা দূর করতে হবে। প্রয়োজনে রোগীর সমস্যা শনাক্ত করে ওষুধ দেওয়ার কথা বলেন ডা. হাসানুল হক। সচেতনতা ও সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে স্লিপ প্যারালাইসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

5h ago