হিকিকোমোরি: জাপানের নিভৃতচারী জনগোষ্ঠী
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/10/31/1_mct3damoiwktxdjjxsjl8q.jpeg?itok=tX_gOjKO×tamp=1667211500)
কখনো কখনো সমাজ ও চারপাশের সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখার প্রবণতা কম-বেশি অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। কিন্তু জাপানে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিজেকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর সমাজ থেকে পুরোপুরি দূরে রাখেন।
তারা সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ থেকে দূরে থাকেন এবং অনেক ক্ষেত্রে টানা কয়েক বছর ধরে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বের হন না। এ ধরনের মানুষদের 'হিকিকোমোরি' বলা হয়।
হিকিকোমোরিদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের কমপক্ষে ৬ মাস বাড়িতে বিচ্ছিন্ন রাখেন, যে কোনো সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন এবং এমন কাজ এড়িয়ে যান যে কাজে তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতে পারে। তারা নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্যুত রেখে আধুনিক যুগের সন্ন্যাসীদের মতো জীবনযাপন করে।
জাপানে এটি একটি গুরুতর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে এই সামাজিক প্রত্যাহারের ঘটনা কিশোর, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ব্যাপকহারে দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের বাড়িতে নির্জনতায় পড়ে থাকেন, এমনকি কয়েক মাস বা বছর ধরে বাইরের কোনো কাজে যান না। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত যান না।
তারা সাধারণত নিজেদের বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। ফলে খাবার বা আশ্রয় নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। তাদের এই চরম সমাজ বিমুখতা যা কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেটি তাদের নিজেদের জন্য এবং যারা তাদের যত্ন নেন অর্থাৎ তাদের পরিবারের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা প্রায় ৫ লাখ ৪১ হাজার জাপানি এই হিকিকোমোরি জীবনযাপন করছেন।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/10/31/1_5ypqrmeztkthbjnfzocazw.jpeg?itok=dag5bv_8×tamp=1667211809)
হিকিকোমোরি শব্দটি, 'হিকি' অর্থাৎ 'প্রত্যাহার করা' এবং 'কোমোরি' অর্থাৎ 'ভেতরে থাকা' থেকে এসেছে। জাপানি মনোবিজ্ঞানী তামাকি সাইতো তার ১৯৯৮ সালে 'সোশ্যাল উইথড্রোয়াল– অ্যাডোলেসেন্স উইদাউট এন্ড' নামের বইয়ে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।
১৯৯০-এর দশকে জাপানি যুবকদের মধ্যে চরম সামাজিক প্রত্যাহার বা বিমুখতার সমস্যাগুলো প্রথম সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। এটি সেই সময়, যখন জাপান একটি অর্থনৈতিক 'আইস এজের' মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, যা অনেক তরুণের লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে।
হিকিকোমোরিরা প্রায়ই শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের ওপর থাকা প্রত্যাশার চাপের কারণে বিচ্ছিন্ন বোধ করেন। গবেষণায় দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া বা ভালো চাকরি না পাওয়ার মতো পরাজয়ের অভিঘাতমূলক অভিজ্ঞতাগুলো সাধারণত এই অবস্থার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। সমাজের প্রত্যাশা, চাপ এবং সামাজিক লজ্জার ভয় এড়াতে অনেকে এই জীবন বেছে নেন।
হিকিকোমোরিকে বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র মানসিক অসুস্থতার পরিবর্তে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। তবে এটি শুধু জাপানেই সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমানে অন্যান্য দেশেও দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ এবং ইতালিতেও এখন এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেখানে অল্পবয়সী বা প্রাপ্তবয়স্করা তাদের বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তাদের সঙ্গে বসবাস করছে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো যেসব দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করা খুব একটা স্বাভাবিক না, সেসব জায়গায় হিকিকোমোরির সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম।
তথ্যসূত্র: দ্য কনভারসেশন, নিপ্পন, বিবিসি
Comments