ভাষা বিকৃতির বিরুদ্ধে ‘মুরাদ টাকলা’র লড়াইয়ের ১০ বছর

আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও ফেসবুকে বাংলা লেখার প্রচলন খুব একটা ছিলো না। অনেকেই বাংলা লিখতেন রোমান-ল্যাটিন ধাঁচে। অর্থাৎ, ইংরেজি ভাষায় আমরা যে বর্ণমালা পাই, সেসব বর্ণমালা (যা মূলত রোমান) ব্যবহার করেই তারা বাংলা লিখতেন। এতে অনেক সময় ধ্বনিতত্ত্বের দিক থেকে বাধতো ঝামেলা। শব্দ হয়ে যেত বিকৃত।
মুরাদ টাকলা কোনো ব্যক্তি নন, বরং ভাষা বিকৃতির ফল। স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও ফেসবুকে বাংলা লেখার প্রচলন খুব একটা ছিলো না। অনেকেই বাংলা লিখতেন রোমান-ল্যাটিন ধাঁচে। অর্থাৎ, ইংরেজি ভাষায় আমরা যে বর্ণমালা পাই, সেসব বর্ণমালা (যা মূলত রোমান) ব্যবহার করেই তারা বাংলা লিখতেন। এতে অনেক সময় ধ্বনিতত্ত্বের দিক থেকে বাধতো ঝামেলা। শব্দ হয়ে যেত বিকৃত।

২০১২ সালের দিকে জনৈক জয়ন্ত কুমার এক পোস্টে লেখেন- murad takla jukti dia bal, Lakapara kara kata bal (মুরাদ টাকলা যুক্তি দিয়া বাল, লাকাপারা কারা কাটা বাল)। বাক্য ২টি আক্ষরিক অর্থে নিলে তা যেমন হাস্যকর লাগে, তেমনি অর্থহীনতাও তৈরি করে।

সেই ব্যক্তি আসলে বলতে চেয়েছিলেন, 'মুরোদ থাকলে যুক্তি দিয়ে কথা বল। লেখাপড়া করে কথা বল।' কিন্তু কেবল সঠিক ধ্বনি অনুযায়ী বর্ণ না লেখায় এই কথা বিকৃত অর্থ ধারণ করে।

সে বছরের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে মুরাদ টাকলা (Murad Takla) নামের ফেসবুক গ্রুপ ও ফেসবুক পেজ। বর্তমানে এই গ্রুপে আছে ৩৬ হাজার সদস্য। 

এই পেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শান্ত কৈরী জানান, ২০১২ সালের ১৪ জুলাই  জয়ন্ত কুমার নামের একজন উল্লিখিত মন্তব্যটি করেন।  ওই মন্তব্যের পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। তারপর বিভিন্নজন এটা ডিকোড করতে বসেন। এর জবাবও পেয়ে যান। তবে প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন এখানেই থেমে থাকেননি। এ নিয়ে তিনি  সামহোয়ারইন ব্লগে লেখেন। লেখাটি হিট হয়। তবে পেজ খোলার কারণ 'জয়ন্ত কুমের' (ওনার ফেসবুক আইডি নামও ছিলো বিকৃত) নন। পরিচিত অনেকেই এমন অদ্ভুতুড়ে সব শব্দে পোস্ট লিখতেন। যার ভেতর গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। মূলত সঠিকভাবে শব্দ লেখার জন্য বোধ জাগ্রত করার উদ্দেশ্যেই পেজটা  খোলা।

শান্ত কৈরী মনে করেন এই ১০ বছরে তারা বেশ সফল হয়েছেন। তিনি বলেন, 'আগের তুলনায় এখন অনেকেই বাংলাতে ঠিকভাবে পোস্ট লিখছে। ভারতে বা অন্যান্য দেশে এখনো অনেকে রোমান হরফে বাংলা লেখে। সে তুলনায় আমাদের দেশে এখন রোমান হরফে ভাষা বিকৃত করে লেখার ব্যাপারটা অনেকটা কমে এসেছে।'

মুরাদ টাকলার ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লালবাগের চালচিত্র ক্যাফেতে আজ শান্ত কৈরীরা এক পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছেন। এই আয়োজনে প্রায় ৫০ জনের মত লোক উপস্থিত থাকতে পারবেন। উপস্থিত ব্যক্তিদের খাবার খরচের একটা অংশ নিজেদের বহন করতে হবে।

শান্ত কৈরী জানান, আগে তারা প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  টিএসসিতে। এ বছর সমাবর্তন উপলক্ষে সেখানে আয়োজনটি করা সম্ভব হয়নি। তাই চালচিত্রকে ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

তবে অনলাইনে বেশ সফল হলেও শান্তর আক্ষেপ আছে অফলাইন কার্যক্রম অতটা ব্যাপকভাবে করতে না পারা নিয়ে। তিনি বলেন, 'আমাদের প্রত্যাশা হলো সবাই সঠিকভাবে বাংলা লিখতে শিখুক। তবে আক্ষেপ আছে অফলাইন হতে না পারা নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে স্কুলে স্কুলে গিয়ে অনলাইনে লেখা এবং অনলাইনে কিভাবে ম্যানার মেইনটেইন করতে হয় তা  শেখানো। এতে যারা অনলাইন মাধ্যমগুলো ব্যবহার করবে, তারা জেনে-বুঝে শিখে আসতে পারবে।'

মুরাদ টাকলার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয় একটি নারকেলের ছবি, যেটিতে থাকা গর্ত যা 'নারকেলের চোখ' বলে পরিচিত- আমাদের কাছে সাধারণভাবে কোনো মুখায়ব মনে হয়।

মুরাদ টাকলার প্রতীক। ছবি: মুরাদ টাকলা পেজ থেকে

মুরাদ টাকলা ভাষা নিয়ে হয়েছে অভিধান প্রণনয়ের কাজও। ২০২০ সালে 'মুরাদ টাকলা ডিকশনারি' নামে একটি সংকলন করেছেন সিমু নাসের ও পীয়্যান মুগ্ধ নবী। এখানে টাকলা ভাষার বিভিন্ন উদাহরণকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করে দেখানো হয়েছে। যেমন- Kaman Asan? 

এই বাক্যের আক্ষরিক রূপ 'কামান আসান?' কিন্তু আসলে এটি হবে- 'কেমন আছেন?'

এক্ষেত্রে বাক্যগুলোকে ইংরেজিতেও অনুবাদ করে তারা দেখিয়েছেন অর্থের পার্থক্য কীরকম হয়। যেমন: 'ame tomr pasa takla to vlo hoto' (আমি তোমার পাশে থাকলে ভালো হতো।)

ইংরেজিতে আক্ষরিক অনুবাদটি দাঁড়ায়- It would have been better  If I were in your ass! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে – I wish I was by your side.  এভাবে শুধুমাত্র ধ্বনিতত্ত্বের ভুলে ভাষার যে চরম বিকৃতি ঘটে সেটিই মজাচ্ছলে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় মুরাদ টাকলা।

তবে অনেকে বিভিন্ন সময় ব্যক্তির সাথে এই পেজের নামকে মিলিয়ে ফেলেন। অনেকে মনে করতেন মুরাদ নামের কোনো টাকমাথা ব্যক্তির নামে হয়তো এই পেজ। এ বছর  সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের অশালীন মন্তব্যর সূত্র ধরে তার পদত্যাগের ব্যাপারটিকে অনেকে এই পেইজের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। প্রচুর মন্তব্য এমন ছিলো যাতে মনে হয়, মুরাদ হাসানকে উদ্দেশ্য করে এই পেজ খোলা হয়েছে। সে সময় পেজটির নেপথ্য ইতিহাস ও এর কার্যক্রম নিয়ে বেশকিছু প্রতিবেদন হয়। এর অ্যাডমিনেরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও তাদের পেজের বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানান।

শান্ত কৈরী বলছিলেন, 'আগে একসময় ফেসবুকে বাংলা লেখা পড়াই যেতো না। এখন সে তুলনায় অনেক ভালোভাবে পড়া যায়। ভারত বা অন্যান্য দেশে এখনো অনেকে রোমান হরফে বাংলা লেখে। সে জায়গায় বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে।'

এই উন্নতির পেছনে মুরাদ টাকলা ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তারা প্রত্যাশা করেন, বিকৃতভাবে নয়, বরং সঠিকভাবে সঠিক উচ্চারণে বাংলা লেখা হবে; যা সঠিক অর্থ প্রকাশ করবে। এভাবে ১০ পা রাখা মুরাদ টাকলা ভাষা বিকৃতির বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চায়।

Comments