জানা-অজানা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন বন্ধু ছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান ও পোল্যান্ডই প্রাধান্য পায়। এখানে চীনের নাম কখনোই অতটা আলোচনায় আসে না। অথচ চীন ছিল এই যুদ্ধের অন্যতম বড় খেলোয়াড়!
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পতাকা। ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান ও পোল্যান্ডই প্রাধান্য পায়। এখানে চীনের নাম কখনোই অতটা আলোচনায় আসে না। অথচ চীন ছিল এই যুদ্ধের অন্যতম বড় খেলোয়াড়!

আলোচনার পরিধি আরেকটু বিস্তৃত করলে একথাও বলা যায়, চীনের এক সিদ্ধান্ত এবং সেখান থেকে জাপানের সঙ্গে যে যুদ্ধের সূত্রপাত, সেটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জটিল প্রেক্ষাপটকে আরও দ্রুত যুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছে। গত বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে শত্রুভাবাপন্ন ও চরম প্রতিযোগিতার সম্পর্ক, তাতে অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বন্ধু! চীনের সাহায্যে মিত্রশক্তি জাপানে বিভিন্ন আক্রমণ পরিচালনা করেছে, যার ফলে জাপান এক পর্যায়ে আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের চীন-জাপান সম্পর্ক

১৮৯৪-১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীন ও জাপানের (সিনো-জাপান) মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পরও এই ২ প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। চিয়াং কাই-সেকের ক্ষমতাসীন ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলার সময়ই জাপান আবারও চীন আক্রমণ করে। ১৯৩১ সালে জাপান চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল দখল করে নিজেদের আজ্ঞাবহ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। চীনের তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের দমনে বেশি ব্যস্ত থাকার সুবিধা নিয়ে জাপানি সৈন্যরা চীনের উত্তরাঞ্চলের আরও অঞ্চল দখলে উদ্যত হয়।

চীনের সঙ্গে জাপানের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপানি সৈন্যরা বেইজিংয়ের মাত্র ১০ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে রাত্রিকালীন প্রশিক্ষণ শুরু করে। জাপানি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ শিবিরটি ছিল ত্রয়োদশ শতকের ভেনেশিয়ান বীর মার্কো পোলোর নামানুসারে করা এক সেতুর পাশে। জাপানের একজন সেনাকর্মকর্তা রাস্তা হারিয়ে ফেলায় নির্ধারিত সময়ে শিবিরে পৌঁছাতে পারেননি। তিনি যখন রাতের বেলা জাপান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করতে চাইছিলেন, তখন চীনা সৈন্যরা তাকে বাধা দেয় এবং তার খোঁজে আসা জাপানি সৈন্যদেরকেও চীনা সেনারা পার্শ্ববর্তী চীনা শহরে প্রবেশে বাধা দেয়। এ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা খুব দ্রুতই যুদ্ধে গড়ায়। যা ইতিহাসে 'মার্কো পোলো ব্রিজ ওয়ার' নামে পরিচিত। এই স্বল্প পরিসরের যুদ্ধই দ্বিতীয় সিনো-জাপানিজ যুদ্ধের সূত্রপাত করে।

দ্বিতীয় সিনো-জাপানিজ যুদ্ধ

চীনের তুলনায় উন্নত প্রযুক্তি, অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম থাকায় খুব দ্রুতই জাপান চীনের ভূমি দখল করে চলছিল। দিনকে দিন জাপানিদের নৃশংসতার মাত্রাও বেড়েই চলছিল। ১৯৩৭ সালের নভেম্বরে জাপানি সৈন্যরা চীনের বাণিজ্যিক নগরী সাংহাই দখল করে নেয়। কিন্তু এটি করতে গিয়ে চীনা সৈন্যদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় জাপানকে। চীনা প্রতিরোধ দমনে আরও নৃশংস হয়ে ওঠে জাপান। তাদের নৃশংসতার জঘন্য একটি উদাহরণ হচ্ছে নানজিং, যে শহরটি জাপানি সৈন্যরা পরের মাসেই দখল করতে গিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, আনুমানিক ৬ সপ্তাহের মধ্যে জাপানি সৈন্যরা ২ থেকে ৩ লাখ চীনা সাধারণ মানুষ ও সেনাদেরকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছে।

১৯৩৮ সালে জাপান চীনের আরও দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল দখল শুরু করে। এক পর্যায়ে চীনের পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। 'দ্য ফরগটেন অ্যালাই: চায়না'স ওয়ার্ল্ড ওয়ার ২, ১৯৩৭-১৯৪৫' বইয়ের লেখক রানা মিটার বলেন, 'তাদের (চীনের) কোনো বন্ধু ছিল না, কোনো অস্ত্রও ছিল না। চীনা জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্ট উভয়ই তখন পালাচ্ছিল।'

মিত্রশক্তিগুলো চীনকে সমর্থন দেওয়া শুরু করলো

জাপানের বিজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তিগুলো চীনের পাশে দাঁড়ানো শুরু করল। সোভিয়েত একনায়ক জোসেফ স্টালিন ভাবলেন জাপানের ক্ষমতা যদি আরও বাড়ে, তাহলে সেটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠবে। স্টালিন যেকোনো মূল্যে চীনে জাপানের পরাজয় দেখতে চাইছিলেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও তিনি চীনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া শুরু করেন। ১৯৪০ এবং ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের সহায়ক সিদ্ধান্তের ফলে চীন আরও বেশি করে অস্ত্র কিনতে পারছিল। ১৯৪১ সালের আগস্টে রুজভেল্ট সরকার জাপানের ওপর বিমান, জ্বালানি ও যুদ্ধসরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ ধাতু আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাপান যেসব কারণে পার্ল হারবার আক্রমণ করেছিল, এই নিষেধাজ্ঞা ছিল তার অন্যতম। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের প্রভাব

দ্বিতীয় সিনো-জাপানিজ যুদ্ধ যেভাবে এগুচ্ছিল, তাতে ১৯৩৮ সালে চীনের আত্মসমর্পণ একরকম অবধারিতই ছিল। পূর্বানুমান অনুসারে চীন যদি আত্মসমর্পণ করেই ফেলত, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসই হয়তো অন্যভাবে লিখা হতো, বা আদৌ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতো কিনা, সেটা নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে।

রানা মিটার বলেন, জাপানি হামলার মুখে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ হয়তো সম্ভব হতো না। তার মানে পার্ল হারবারে আক্রমণ হতো না। কারণ, রুজভেল্ট সরকার যে জাপানের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেটি তো চীনকে সাহায্য করার জন্যই। জাপানও তখন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য উন্মত্ত হয়ে জ্বালানি তেলের উৎসের সন্ধান করছিল। উপায়ন্তর না দেখে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে বসে। পার্ল হারবারে আক্রমণ না করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো এশিয়াতে আসতোই না। পার্ল হারবার আক্রমণের পরই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ও সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন বন্ধু!

পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন একযোগে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, তখন কৌশলগত কারণে মিত্রশক্তিগুলো চীনে অর্থ, অস্ত্র এবং উপদেষ্টার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চীনকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আরেকটি 'পুলিশম্যান' হিসেবে বিবেচনা করে, যারা বিশ্বের পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত নতুন ভরকেন্দ্রকে অক্ষুণ্ণ রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমানগুলো একদিকে চীনের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে জাপানের উপর ব্যাপক বিমান হামলা পরিচালনা করে, অন্যদিকে চীনা সেনারা স্থলভাগে জাপানি সেনাদের মোকাবেলা করতে থাকে। সে সময় প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ জাপানি সৈন্য এবং তাদের ৫১টি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের মধ্যে ৩৮টিই চীনে একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৪৪ সালে 'ইচি-গো' অভিযানের সময় জাপান চীনের কিছু বিমানঘাঁটি দখল করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক প্রবেশের পর তাদের সেনারা মাঞ্চুরিয়াতে জাপানের ঘাঁটি দখল করে নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার পর জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।

Comments