আনসিঙ্কেবল স্যাম: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৩ বার জাহাজডুবি থেকে বেঁচে যাওয়া বিড়াল
কালো ও সাদা রঙের বিড়ালটির প্রথমে অস্কার নামে পরিচিত ছিল। পরে এটির নাম দেওয়া হয় আনসিঙ্কেবল স্যাম। বলা হয়ে থাকে, এই বিড়ালটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনটি জাহাজডুবির ঘটনা থেকে বেঁচে যায়। বিড়ালটি নাৎসি নৌবাহিনীর ক্রিগসম্যারিনের বহরে ছিল। সবশেষ এটি ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে অবস্থান করে। বিসমার্ক, এইচএমএস কস্যাক এবং এইচএমএস আর্ক রয়্যালের জাহাজে এই বিড়ালটি অবস্থান করে। তিনটি যুদ্ধ জাহাজই ধ্বংস হয়ে যায়।
'দ্য টেল অফ আনসিঙ্কেবল স্যাম' প্রথমে নাৎসি যুদ্ধজাহাজ বিসমার্কে কাজ শুরু করে। বিসমার্ক ছিল নাৎসি জার্মানির ক্রিগসম্যারিনের জন্য নির্মিত দুটি বিসমার্ক-শ্রেণির যুদ্ধজাহাজের মধ্যে প্রথম। এটি জার্মানি দ্বারা নির্মিত সর্ববৃহৎ জাহাজগুলোর একটি।
জানা যায়, একজন ক্রুম্যান যুদ্ধজাহাজে একটি বিড়াল নিয়ে আসে। বিড়ালটি ১৯৪১ সালের ১৮ মে বিসমার্কে ছিল। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালের ২৭ মে ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে তিন দিনের তীব্র যুদ্ধের পর বিসমার্ক ধ্বংস হয়ে যায়। জাহাজটি ডুবে যায়। সেখানে ২ হাজার ২০০ জনের বেশি সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, মাত্র ১১২ থেকে ১১৮ জন বেঁচে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর বিড়ালটিকে একটি বোর্ডে ভাসতে দেখা যায়। এইচএমএস কস্যাক জাহাজের ক্রুরা পানি থেকে বিড়ালটিকে উদ্ধার করে। ক্রুরা বিড়ালটির নাম জানতো না। তাই তাকে অস্কার বলে ডাকতে থাকে। এভাবেই আনসিঙ্কেবল স্যাম নাৎসি থেকে মিত্র বাহিনীর লোকজনের হাতে যায়।
বিসমার্কের পর স্যামের নতুন ঠিকানা হয়, এইচএমএস কস্যাক। বিড়ালটি পরের কয়েক মাস কস্যাকে অবস্থান করে। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। শেষ পর্যন্ত একটি টর্পেডো দ্বারা এই জাহাজটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজটি ১৯৪১ সালের ২৪ অক্টোবর জিব্রাল্টার থেকে ব্রিটেনে একটি কনভয়কে সহযোগিতা করছিল। তখন এটি জার্মান ইউ-বোট-৫৬৩ দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। জাহাজটি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রথম টর্পেডোর আঘাতে সামনের একটি অংশ উড়ে যায় এবং ১৫৯ জন ক্রু সদস্য নিহত হন। অস্কারকে একটি তক্তার টুকরোতে আঁকড়ে ধরা অবস্থায় পাওয়া যায়। এবার অস্কারকে বিমান-বাহক এইচএমএস আর্ক রয়্যালের ক্রুরা উদ্ধার করে। ব্রিটিশ অফিসাররা তখন বিড়ালটির নাম রাখে আনসিঙ্কেবল স্যাম।
আনসিঙ্কেবল স্যামকে তখন এইচএমএস আর্ক রয়্যালের ক্রুরা দত্তক নেয়। এই আর্ক রয়্যাল স্যামের প্রথম জাহাজ বিসমার্ককে ডুবিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিল।
আর্ক রয়্যাল বেশ কয়েকটি আক্রমণ থেকে বেঁচে একটি 'ভাগ্যবান জাহাজ' হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯৪১ সালের ১৪ নভেম্বর মাল্টা থেকে ফেরার পথে এই জাহাজটিও একটি ইউ-বোট-৮১ এর টর্পেডো দ্বারা আক্রান্ত হয়। জাহাজটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটিকে জিব্রাল্টারে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় তীর থেকে ৩০ মাইল দূরে ফেলে আসা হয়। এ সময় স্যামকে 'অক্ষত ও রাগান্বিত' অবস্থায় একটি মোটর লঞ্চের দ্বারা ভাসমান তক্তাকে আঁকড়ে থাকতে দেখা যায়।
তারপরে তাকে এইচএমএস লাইটিনিং এবং পরে এইচএমএস লিজিয়নে স্থানান্তরিত করা হয়। স্যাম সাগর ছেড়ে স্থলে আসে। পরে তাকে অন্য চাকরিতে স্থানান্তরিত হয় এবং জিব্রাল্টারের গভর্নর জেনারেলের ভবনে ইঁদুর শিকারে জন্য পাঠানো হয়। অবশেষে, তাকে যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়। স্যাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেলফাস্টে একটি 'হোম ফর সেইলরস' ছিল। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ, শিল্পী জর্জিনা শ-বেকার স্যামের একটি প্যাস্টেল পেইন্টিং তৈরি করেছিলেন। এটির শিরোনাম ছিল 'অস্কার, বিসমার্কের বিড়াল', যা বর্তমানে গ্রিনিচের ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়ামে আছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আনসিঙ্কেবল স্যাম কী আসলেই ছিল নাকি এটি শুধু একটি সমুদ্রের গল্প?
অনেকের কাছে, ঘটনাটির সত্যতা বেশ অবিশ্বাস্য। তারা এই গল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং এটিকে 'সমুদ্রের গল্প' হিসেবে মনে করে। অনেকেই বিসমার্কের ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে স্যামের বেঁচে যাওয়াকে বেশ অসম্ভব বলে মনে করে। এছাড়া অনেকে মনে করেন, স্যাম যে আসলেই ছিল তার কোনো পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। বিসমার্কের ডুবে যাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিক লুডোভিক কেনেডির বিবরণে স্যামের কোনো উল্লেখ নেই বা যুদ্ধজাহাজে এই বিড়ালকে আনা হয়েছিল এমন কোনো রেকর্ডও নেই। অনেকেই এই গল্পের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ করেন।
আবার অনেকে বিশ্বাস করেন যে স্যাম এর অস্তিত্ব ছিল। তারা জাহাজের রেকর্ডে স্যামের নাম না থাকার অসঙ্গতির ব্যাখ্যা করেন যে, বিড়ালটি বিসমার্কের একটি সরকারি পশুর মাসকটের পরিবর্তে একটি স্টোওয়ে হতে পারে। যার ফলে বিড়ালটিকে জাহাজের যাত্রী তালিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত করা হয়নি। অন্যদিকে, তারা জর্জিনা শ-বেকারের আঁকা প্যাস্টেল প্রতিকৃতির দিকেও ইঙ্গিত করে দাবি করে যে স্যাম যদি না-ই থাকতো তাহলে তাকে আঁকার কোনো কারণ ছিল না।
দ্য আনসিঙ্কেবল স্যামের গল্প নিয়ে সন্দেহের কারণ থাকলেও তাতে বিশ্বাস করারও কারণ আছে। কেননা ইঁদুর থেকে রক্ষার জন্য জাহাজে বিড়াল আনার চর্চা ছিল। অন্যদিকে, যুদ্ধকালীন সময়ে পোষা প্রাণীদের নিয়ে আসার কোনো নতুনত্ব ছিল না। বিশেষ করে কুকুর এবং বিড়ালের মতো প্রাণী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও অনেক আগে থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যেত। এছাড়া ভাল্লুক, মুরগি, ইঁদুর এবং বানরের মতো বন্য প্রাণীও সৈন্যদের সঙ্গে ছিল। বেশিরভাগই যুদ্ধের সময় সৈন্যদের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্য পাশে থাকতো এসব প্রাণী। কখনো কখনো প্রাণীরাও যুদ্ধে সাহায্য করত। কুকুর এবং পায়রা সাধারণত যুদ্ধের সামনের সারিতে মোতায়েন করা হত। স্যাম ছাড়াও সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া আরও অনেক বিড়ালের তথ্য পাওয়া যায়।
Comments