বিলিভ ইট অর নট

ব্লেমিস: মাথাবিহীন মানুষের দল

ব্লেমিস: মাথাবিহীন মানুষের দল
মাথাবিহীন মানুষের দল ব্লেমিস। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

মাথাবিহীন ভূতদের কথা আমরা শুনেছি। স্কন্ধকাটা নামের এই ভূতেদের কোনো মাথা থাকে না। রামায়ণে পাওয়া 'কবন্ধ' নামের পিশাচও মাথাবিহীন। তার একটি চোখ প্রোথিত ছিল পেটের ভেতর; আর ছিল বিশাল বাহুসমেত হাত। এ ছাড়া চীনা দেবতা জিংশিয়ানেরও কোনো মাথা নেই। তার বদলে নাভির স্থানে আছে মুখ আর ২ স্তনের ২ বৃন্তের জায়গায় দুটো চোখ! হুয়াংডির যুদ্ধে শিরশ্ছেদের শিকার হয়ে তার এই পরিণত হয়।

তবে এরা সবই পৌরাণিক চরিত্র। কিন্তু যদি বলা হয়, বাস্তবেও দেখা গেছে এমন মাথাবিহীন জীবদের- তাও আবার মানুষ! অনেকের কাছেই তা মনে হতে পারে নিছক বানানো গল্প। তবে 'ব্লেমিস' বলে পরিচিত এমন মাথাবিহীন মানুষদের অস্তিত্ব ছিল- এমনটিই বলছে প্রাচীন বিভিন্ন লেখা। 

'জিওগ্রাফি অব স্ট্রাবো' তে পাওয়া যায় 'ব্লেমিস' শব্দটির উল্লেখ। প্রথম শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিক স্ট্রাবো উল্লেখ করেন তাদের কথা। না, কোনো দানব নয় তারা। স্ট্রাবোর মতে, তারা ছিলো একটি আদিবাসী গোত্র- যাদের বসবাস ছিলো নুবিয়ার নিম্নভূমিতে। এই জায়গাটি পড়েছে আজকের দিনের ইথিওপিয়ায়। শুধু সেখানেই নয়, নীলনদ হয়ে তাদের বসতি বিস্তার লাভ করেছিলো লোহিত সাগর পর্যন্ত। 

গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের লেখাতেও এসেছে মাথাবিহীন মানুষদের কথা। তাদের কারও কারও চোখ থাকতো বাহুতে, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে সেটি বুকে বা পেটের মাঝে!

হেরোডোটাসের এই অদ্ভুত মানুষদের স্ট্রাবোর বর্ণনায় পাওয়া একই গোষ্ঠী বলে মত দেন রোমান লেখক ও ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এলডার। 

'ন্যাচারাল হিস্ট্রি' নামের বইয়ে প্লিনি দেন তাদের বিশদ বিবরণ। তার মতে, 'ব্লেমিসদের কোনো মাথা থাকতো না, তাদের মুখ আর চোখগুলো থাকতো তাদের বুকে!' তবে তিনি কিংবা হেরোডোটাস- কেউই নিজ চোখে এদের দেখেননি। তাদের বর্ণনার সূত্র হলো- শোনা কথা বা লোকমুখে প্রচলিত গল্পগাথা। এ ছাড়া দার্শনিক সোলিনাসের বর্ণনাতেও লোকমুখে শোনা এ ধরনের জীবদের কথা এসেছে। 

তবে এ ক্ষেত্রে চমকপ্রদ একটি বিষয় হলো সেনাপতি মার্কাস অরেলিয়াসের বাহিনীর বিরুদ্ধে 'পালমিরার যুদ্ধে' ব্লেমিসদের লড়াই। এমনো প্রচলিত আছে, থেবাইস দ্বীপটি ছিলো ব্লেমিসদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের থেকে দ্বীপটি অধিকার করে নিতেই অরেলিয়াস তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ও ব্লেমিসদের বাহিনী কার্যত পরাজয় বরণ করে।

তবে এরা খিষ্টপূর্ব যুগের মানুষ। কিংবা খ্রিষ্ট্রীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীর।  মধ্যযুগে কিংবা তারপরও কিন্তু কারও কারও বর্ণনায় এসেছে এদের কথা। 

চতুর্দশ শতাব্দীতে পর্যটক স্যার জন ম্যানডেভিল তার 'দ্য ট্রাভেলস অব স্যার জন ম্যানডেভিল'-এ এদের উল্লেখ করেন। তিনি এদের উল্লেখ করেন- 'লোকমুখে শোনা, উদ্ভট গড়নের জীব' বলে। তার বর্ণনামতে, এরা মাথাবিহীন। এদের চোখ থাকতো কাঁধে। তবে ম্যানডেভিলের বর্ণিত এই ব্লেমিসরা কিন্তু আফ্রিকার নয়। তিনি এদের থাকার জায়গা হিসেবে বলেছেন এশিয়ার প্রত্যন্ত কিছু দ্বীপের কথা। 

ষোড়শ- সপ্তদশ শতকের অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র‍্যালেই এর বর্ণণাতেই এমন অদ্ভুত এক প্রাণীর কথা পাওয়া যায়, যেটির সঙ্গে মাথাবিহীন এই ব্লেমিসদের বেশ সাদৃশ্য আছে। তিনি এদের নাম উল্লেখ করেন- 'এয়াইপানোমা'। এদের মাথা নেই। চোখ থাকে কাঁধে, আর ২ স্তনের মাঝের জায়গায় থাকে মুখ। তাদের মাথার পেছনে দুদিকের ঘাড় বেয়ে নেমে আসে দীঘ চুল। তবে র‍্যালেই এদের আবাস হিসেবে বলেন দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানা দ্বীপপুঞ্জের কথা। 'ডিস্কোভারি অব গায়ানায়' তিনি উল্লেখ করেন, এদের বসতি ছিলো কাউরা নদীর তীরে। তিনিও কখনো এদের নিজের চোখে দেখেননি, তবে তিনি যে পরিমাণ মানুষদের এর অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে শোনেন, তাতে তার মনে হয়েছিল এদের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে! অ্যারোমায়া ও কানুরি প্রদেশগুলোর শিশুরা পর্যন্ত বলতো তাদের দেখতে পাওয়ার কথা! 

তবে সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জোয়ানেস দ্য লায়েট এ ধরনের মানুষদের অস্তিত্বকে গালগল্প বলে উড়িয়ে দেন। তিনি মনে করতেন, হয়তো এমন কোনো গোষ্ঠী আছে যাদের গলা খুব ছোট অথবা শরীর বিশাল আকৃতির হলেও মাথা সে তুলনায় ছোট। একারণে দূর থেকে দেখলে মনে হয় মাথাবিহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

পরবর্তীকালে কোনো পর্যটকের লেখায় এদের স্পষ্টভাবে দেখা গেছে এমন প্রমাণ মেলেনি। কাজেই ব্লেমিস বা মাথাবিহিন মানুষদের অস্তিত্বের ব্যাপারটি কোনো প্রামাণ্য সত্য নয়। বরং, এটিকে প্রচলিত লোকজ গল্পগাথা বা সর্বোচ্চ লোকজ কিংবদন্তী হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। 

তথ্যসূত্র: রিপলি'স বিলিভ ইট অর নট
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

9h ago