যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘এলিয়েনের যান’ থাকার দাবি সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার

‘মহাবিশ্বে আমরা একা নই’
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের প্রকাশ করা ভিডিওতে আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট (ইউএফও)। ছবি: পেন্টাগন

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড গ্রুশ সম্প্রতি এক চমকপ্রদ তথ্য ফাঁস করেছেন। তার দাবি, মার্কিন সরকারের কাছে ভিনগ্রহবাসী বা এলিয়েনের ব্যবহৃত 'অক্ষত এবং আংশিক অক্ষত' যান রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে যেগুলোকে আনআইডেন্টিফাইড ফ্লায়িং অবজেক্ট (ইউএফও) হিসেবে জল্পনা করে আসছে মানুষ।

গত ৬ জুন দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে ইউএফও সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ইউএফও চাইনিজ স্পাই বেলুনের মতোই, যেগুলোর কোনো না কোনো ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু অনেকগুলোর আবার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড গ্রুশ ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স এজেন্সির অধীনে আনএক্সপ্লেইনড অ্যানোমেলাস ফেনোমেনা (ইউএপি) শনাক্তের কাজে নেতৃত্ব দেন। যাদের কাজ হলো পৃথিবীতে ঘটা বিভিন্ন অব্যক্ত অস্বাভাবিক ঘটনা বিশ্লেষণ করা।

ডেভিড গ্রুশ জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মানবসৃষ্ট নয় এমন যান রয়েছে। তার দাবি অনুসারে, মার্কিন সরকারের কাছে এলিয়েন যান আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গণমাধ্যম দ্য ডেব্রিফকে ডেভিড গ্রুশ বলেন, 'এসব এলিয়েন যানের তথ্য মার্কিন কংগ্রেস থেকে অবৈধভাবে আটকে দেওয়া হচ্ছে।'

ডেভিড গ্রুশের অভিযোগ, তিনি যখন এই যানগুলো সম্পর্কে অতি গোপনীয় তথ্য কংগ্রেসের কাছে জমা দিয়েছিলেন, তখন তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন। 

মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগে ১৪ বছরের কর্মজীবন শেষে গত এপ্রিলে অব্যাহতি নেন ডেভিড গ্রুশ। এরপরই তিনি এলিয়েন যানের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেন।     
 
শুধু ডেভিড গ্রুশই নন, এরপর অপর এক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনাথন গ্রে, যিনি বর্তমানে ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস ইন্টেলিজেন্স সেন্টারে (এনএএসআইসি) কর্মরত, তিনিও ডেব্রিফের কাছে 'বহিরাগত উপকরণ'-এর অস্তিত্ব থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, 'মহাবিশ্বে আমরা একা নই।'

গার্ডিয়ান জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন অজ্ঞাত যান শনাক্ত হওয়ার খবরে আবারও এলিয়েন যান বা ইউএফও'র দিকে মানুষের মনোযোগ টেনে নেয়। এরমধ্যেই আবার নতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে।

২০২১ সালে ইউএপি'র ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদরদপ্তর পেন্টাগন। বহির্জাগতিক বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করা অধিকাংশ কমিউনিটি ইউএপি শব্দটিকে ইউএফও বোঝাতেই ব্যবহার করেন। প্রতিবেদনে ইউএপি দেখতে পাওয়ার ১৪০টিরও বেশি ঘটনা তুলে ধরা হয়। যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যায়নি।

এর আগে একটি সামরিক ফুটেজ ফাঁস হওয়ার পর এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ফাঁস হওয়া ফুটেজে আকাশে অবর্ণনীয় কিছু ঘটতে দেখা যায়। মার্কিন নৌবাহিনীর পাইলটরা সাক্ষ্য দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে তারা প্রায়শই অদ্ভুত সব উড়ন্ত যানের মুখোমুখি হন।

ডেব্রিফের দুই সাংবাদিক লেসলি কিন ও রাল্ফ ব্লুমেন্থাল, যারা এর আগে ইউএফও নিয়ে তদন্ত করে এমন এক গোপন পেন্টাগন প্রোগ্রামের অস্তিত্ব উন্মোচন করেছিলেন, তাদের কাছে এক সাক্ষাতকারে ডেভিড গ্রুশ বলেন, 'কয়েক দশক ধরে মার্কিন সরকার এবং প্রতিরক্ষা কন্ট্রাক্টররা মনুষ্যনির্মিত নয় এমন যানের টুকরোগুলো উদ্ধার করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ যানও উদ্ধার করেছে।'  

সাবেক এই মার্কিন গোয়েন্দা ডেব্রিফকে বলেন, 'আমরা সাধারণ উৎস থেকে প্রাপ্ত বা পরিচিত কিছুর কথা বলছি না। এসব সামগ্রীর মধ্যে অক্ষত এবং আংশিক অক্ষত যানও রয়েছে।' 

তিনি আরও বলেন, 'বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব সামগ্রী বহিরাগত উৎসের। যার মানে বহির্জাগতিক বা অজানা উৎসের, মানুষ নয় এমন বুদ্ধিমত্তার তৈরি।'

ডেভিড গ্রুশ আরও বলেন, 'এই মূল্যায়নটি যানের আকারবিদ্যা, উপাদান পরীক্ষা, অনন্য পারমাণবিক অবস্থা এবং রেডিওলজিক্যাল সিগনেচারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।'

ডেব্রিফ জানায়, এনএএসআইসি-তে কর্মরত মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জনাথন গ্রে, যিনি ব্যাখ্যাতীত অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করেন, তিনিও ডেভিড গ্রুশের বক্তব্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

জনাথন গ্রে বলেন, 'মানুষের বাইরে বুদ্ধিমত্তা থাকার ঘটনাগুলো বাস্তব। আমরা একা নই। এ ধরনের ঘটনা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বৈশ্বিক ঘটনা এবং তবুও এগুলোর বৈশ্বিক সমাধান আমরা পাচ্ছি না।'

ডেভিড গ্রুশের এই দাবির সত্যতা ও তার সম্পর্কে জানতে তার বেশ কয়েকজন সাবেক সহকর্মীর সঙ্গেও কথা বলেছে ডেব্রিফ। যাদের প্রত্যেকেই ডেভিড গ্রুশের চরিত্র সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করেছেন। তাদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্নেল কার্ল ই নেল বলেন, 'গ্রুশ অনিন্দ্য'। এ ছাড়া, ২০২২ সালে কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে গ্রুশকে 'সম্ভাব্য সবচেয়ে শক্তিশালী নৈতিকতা-সম্পন্ন কর্মকর্তা' হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

আরেকজন নিক পোপ, যিনি ১৯৯০-এর দশকের গোঁড়ার দিকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হয়ে ইউএফও নিয়ে তদন্ত করেন। তিনি বলেন, 'গ্রুশ ও গ্রের এলিয়েন সরঞ্জাম সম্পর্কিত বিবরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।'

নিক পোপ বলেন, 'বিভিন্ন কনস্পাইরেসি ব্লগে থাকা গল্পগুলো এক জিনিস, কিন্তু এ সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ প্রকৃত ব্যক্তিরা যখন এসব বিষয় প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, তখন এর গুরুত্ব অন্য লেভেলে চলে যায়।'  

'যখন এসব লোকেরা এই ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগগুলো করেন, তখন তারা বুঝে-শুনেই করেন। তারা যদি সব জেনেও মিথ্যা বিবৃতি দেন, তবে মোটা অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি তাদের কারাগারেও যেতে হতে পারে', যোগ করেন নিক।

তিনি আরও বলেন, 'অনেকে বলেন, ওহ- মানুষ তো সবসময়ই বিভিন্ন গল্প তৈরি করে। কিন্তু আমি মনে করি, এমন দাবি নিয়ে কংগ্রেসের সামনে যাওয়া এবং গোয়েন্দা কমিউনিটির ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছে যাওয়া এবং এমনটি করা আসলেই আলাদা। কারণ এখানে মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরিণতির ভয় রয়েছে।'

ডেব্রিফের তথ্যানুসারে, অজ্ঞাত উপকরণ এবং যান সম্পর্কে ডেভিড গ্রুশের জ্ঞান 'উচ্চস্তরের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিস্তৃত সাক্ষাৎকার'-এর ভিত্তিতে পাওয়া। গ্রুশ জানান যে, একটি ইউএফও সরঞ্জাম 'পুনরুদ্ধার প্রোগ্রাম'-এর অস্তিত্বের কথাও তিনি কংগ্রেসে তুলে ধরেছেন।

গ্রুশ বলেন, 'এলিয়েন যান উদ্ধারের কার্যক্রম বিভিন্ন স্তরে চলমান রয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িত বর্তমান ও সাবেক নির্দিষ্ট ব্যক্তিদেরও তিনি চেনেন।'

তবে ডেভিড গ্রুশ নিজ চোখে এলিয়েন যান দেখেছেন কি না এবং সেগুলো কোথায় সংরক্ষণ করা হতে পারে ডেব্রিফের প্রতিবেদনে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। 

২০২১ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অফিসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সামরিক পাইলটরা মোট ১৪৪ বার ইউএপি বা অজ্ঞাত যানের মুখোমুখি হয়েছেন। যার মধ্যে ৮০টি যান বিভিন্ন সেন্সরে ধরাও পড়েছে। তবে ১৪৪টি ঘটনার ক্ষেত্রে মাত্র একটিকে অতি উচ্চ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বড় চুপসে যাওয়া বেলুন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।

মার্কিন জনগণ ও কিছু সিনেটরদের আগ্রহের কারণে পেন্টাগন ২০২২ সালের জুলাই মাসে ইউএপি ট্র্যাক করার জন্য অল-ডোমেন অ্যানোমালি রেজুলেশন অফিস প্রতিষ্ঠা করে। গত বছরের ডিসেম্বরে অফিসটি জানায় যে, তারা কয়েকশ নতুন খবর পেয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত এলিয়েন সত্ত্বার কোনো তথ্য-প্রমাণ পায়নি।

মার্কিন নৌবাহিনীর পাইলট, যারা ২০২১ সালে সামরিক ফ্লাইট পরিচালনার সময় অজ্ঞাত বস্তুর মুখোমুখি হন, তারা জানান যে, অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের কারণে তারা বিষয়টিকে তখন প্রকাশ্যে আনেননি। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল যে, এতে তাদের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এদিকে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ইউএপি ইন্ডিপেন্ডেন্ট গবেষণা দলের ইন্ডিপেন্ডেন্ট চেয়ার ডা. ডেভিড স্পারগেল গার্ডিয়ানকে জানান যে, তিনি ডেভিড গ্রুশকে চেনেন না এবং তার দাবি সম্পর্কেও তিনি অজ্ঞাত। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগও তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। 

এক বিবৃতিতে নাসার এক মুখপাত্র বলেন, 'নাসার প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর একটি হলো মহাবিশ্বের অন্য কোথাও জীবনের সন্ধান করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত নাসা বহির্জাগতিক জীবনের কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পায়নি এবং ইউএপিগুলো বহির্জাগতিক বলেও কোনো প্রমাণ নেই। যাই হোক, মহাবিশ্বে আমরা একা আছি কি না-সহ এ ধরনের বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পেতে নাসা সৌরজগত এবং তার বাইরেও অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছে।'

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হয়ে ইউএফও নিয়ে তদন্তকারী নিক পোপ জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হয়ে ইউএফও নিয়ে তদন্তের সময় তিনি নিজে কোনো এলিয়েন যান বা উপকরণের কোনো শক্তপোক্ত প্রমাণ পাননি। 

তিনি বলেন, 'কিছু ঘটনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। কিন্তু আমাদের হ্যাঙ্গারের কোথাও কোনো স্পেসশিপ ছিল না। যদি থেকে থাকেও, তারা আমাকে জানায়নি।' 

'তবে ডেভিড গ্রুশের দাবিগুলোকে ইউএফও সম্পর্কে তথ্যের ক্রমবর্ধমান প্রবাহের অংশ হিসেবে দেখা উচিত এবং মনেকরি সত্যটা প্রকাশ করা উচিত', বলেন পোপ। 

অনুবাদ: আহমেদ বিন কাদের অনি

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

 

Comments