ভূত কি সত্যিই আছে?

আপনি যদি ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, তবে আপনি একা নন। আপনার মতো লাখো মানুষ এই বিশ্বাস ধারণ করেন। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই ভূতের বিশ্বাস আছে। আর ভূত হচ্ছে এই গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয় অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসগুলোর একটি।
২০১৯ সালের ইপসোস জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪৬ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেন ভূতের অস্তিত্ব আছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো মাত্র সাত শতাংশ মানুষ ভ্যাম্পায়ারদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন।
২০১৫ সালের পিউ রিসার্চের আরেকটি জরিপে বলা হয়েছে, প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ দাবি করেছেন, তারা ভূত দেখেছেন বা ভূতের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছেন।
সম্ভবত বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো জরিপ চালানো হলো এ সংখ্যা আরও বেশি হবে!
কেন এত মানুষ এই দাবি করেন?
এ বিষয়ে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ও সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অ্যাডওয়ার্ডসভিলের অধ্যাপক স্টিফেন হাপ বিজ্ঞান সাময়িকী লাইভ সায়েন্সকে বলেন, এর অন্যতম কারণ হতে পারে 'প্যারিডোলিয়া'। এটি মস্তিষ্কের এমন এক প্রবণতা—যেখানে অস্পষ্ট জিনিসেও মানুষ মুখ বা মানবসদৃশ অবয়ব খুঁজে পায়। যেমন, মেঘের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মুখ দেখা, অথবা অন্ধকার ঘরে ছায়া দেখে ভূত মনে হওয়া।
প্রাচীনকাল থেকেই ভূতে বিশ্বাস
ভূতের অস্তিত্বের ধারণা বহু প্রাচীন। বাইবেল থেকে শুরু করে শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ—ভূত হাজির সর্বত্র। এটি কেবল এক ধরনের গল্প নয়, বরং বিশ্বের বিরাট একটি অংশের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নানান লোককাহিনী তৈরি হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য এই বিশ্বাস অনেক মানুষকে সান্ত্বনা দেয়। কে না চায় প্রিয়জনরা সঙ্গে থাকুক। আত্মা যদি সঙ্গে থাকে, বিপদে উদ্ধার করে, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়—এই ভাবনা অনেকের জন্য স্বস্তিদায়ক হতেই পারে।
মানুষ বহুকাল ধরে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন বা দাবি করেছেন। যেমন—ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে চা খাওয়ার পর উচ্চবর্গের নারীরা ড্রইংরুমে বসে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সিয়েন্স (প্রেততাত্ত্বিক গবেষণার সভা) করতেন। ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতের প্রমাণ খোঁজার জন্য গঠন হয় 'ঘোস্ট ক্লাব'। ১৮৮২ সালে গঠিত হয় 'সোসাইটি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চ'। এর এক নারী সদস্য এলিনর সিডউইক ছিলেন ভূতের তদন্তকারী ও পরে সভাপতি হন।
১৮০০ দশকের শেষের দিকে আমেরিকায় অনেক মনোবিজ্ঞানী দাবি করেছিলেন, তারা মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু পরে সেগুলো হ্যারি হুডিনির মতো তদন্তকারীদের মাধ্যমে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
ভূত খোঁজা
ভূত খোঁজা বা 'ঘোস্ট হান্টিং' সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সাই-ফাই চ্যানেলের টিভি সিরিজ 'ঘোস্ট হান্টার' এর মাধ্যমে। তবে ২৩২টি পর্বেও তারা ভূতের অস্তিত্বের কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেনি। বাংলাদেশেও বিভিন্ন এফএম রেডিওতে ভূত নিয়ে প্রোগ্রাম হয়।
এসব শো দেখায় যে, কেউ ভূত খুঁজতে চাইলে তাকে বিজ্ঞানী হতে হবে না—স্রেফ ফ্রি সময়, অন্ধকার জায়গা ও কয়েকটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র হলেই চলে। কেউ যদি সময় নিয়ে ভূত খোঁজেন তাহলে কোনো আলো বা শব্দের সন্ধান পেতে পারেন। যেগুলোর আবার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
অবশ্য ভূতের ঘটনার জন্য এই অস্পষ্ট মানদণ্ডই সমাজের বিভিন্ন মিথগুলোকে স্থায়ী করেছে।
ভূত, বিজ্ঞান ও যুক্তি
বৈজ্ঞানিকভাবে ভূতের অস্তিত্ব মূল্যায়নে একটি বড় বাধা হলো—যেসব বিষয়কে 'ভূত' বলা হয় তার ধরন খুবই বৈচিত্র্যময়। যেমন—একটি দরজা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, চাবি হারিয়ে যাওয়া, ঠাণ্ডা অনুভব বা মৃত আত্মীয়ের উপস্থিতি দেখা। মানুষ এসবকে ভূতের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে।
সমাজবিজ্ঞানী ডেনিস ও মিশেল ওয়াস্কুল ঘোস্টলি এনকাউন্টারস: দ্য হন্টিংস অব এভরিডে লাইফ (টেম্পল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৬) বইটি লিখতে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যারা ভূত দেখেছেন বলে দাবি করেন। অথচ তাদের অনেকে নিশ্চিত ছিলেন না—তারা আদৌ ভূত দেখেছেন কি না। তারা কেবল অস্বাভাবিক, অজানা কিছু দেখেছেন বা বুঝতে পেরেছেন। সেগুলো সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেগুলো মানুষের চর্চিত ভূতের মতো কিছু নয়।
আরও জটিলতা তৈরি করে ঘুমের সময় শরীর অবশ হয়ে যাওয়া বা 'স্লিপ প্যারালাইসিস'। এতে মানুষ মনে করে, তারা ভূত, দৈত্য বা এলিয়েন দেখেছেন।
কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এক বিষয়, আর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আরেক বিষয়। ভূত নিয়ে কথা বলার একটি অসুবিধা হলো, ভূত কী তা নিয়ে সর্বজনীনভাবে সম্মত কোনো সংজ্ঞা নেই। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যেসব আত্মা পথ হারিয়ে ফেলে তারা ভূত হয়ে যায়। আবার কেউ দাবি করেন, ভূত আমাদের মনে গেঁথে থাকা টেলিপ্যাথিক সত্তা। কেউ কেউ আবার ভূতের নানা নামকরণ করেন—মেছোভূত, গেছোভূত, ডাইন ইত্যাদি।
অবশ্যই এগুলো সবই কল্পনাপ্রসূত। এগুলোর পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
ভূতের ধারণা নিয়ে প্রচলিত যুক্তিগুলো নিজেরাই নিজেদের বিপরীত। যেমন—ভূত বস্তুগত নাকি অবস্তুগত? ভূত যদি বস্তুগত না হয়, তাহলে তারা কীভাবে দরজা বন্ধ করে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে? আবার যদি বস্তুগত হয়, তাহলে তারা দেওয়াল ভেদ করে কীভাবে চলে যায়?
আরেকটি প্রশ্ন, ভূত যদি মৃত আত্মার প্রতিচ্ছবি হয়, তবে তারা কেন জামাকাপড় পরা থাকে? জামাকাপড়ের তো আত্মা নেই!
অনেকে বলেন, খুন হওয়া ব্যক্তির প্রতিশোধ নিতে আত্মা ভূত হয়ে যায়। তাহলে কীভাবে সেই খুনি বা অপরাধী বেঁচে থাকেন? কেন তার বিচার হয় না?
বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করেও আজ পর্যন্ত ভূতের অস্তিত্বের কোনো বিশ্বাসযোগ্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভূত নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা ভূত শনাক্তে ব্যবহৃত যন্ত্র গাইগার কাউন্টার, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড (ইএমএফ) ডিটেক্টর, আয়ন ডিটেক্টর, ইনফ্রারেড ক্যামেরা ও সংবেদনশীল মাইক্রোফোনের মতো উচ্চ-প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেন।
মনোবিজ্ঞানী স্টিফেন হাপ বলেন, 'যদি কেউ আপনাকে ভূত ধরার যন্ত্র দিয়ে টাকা নিতে চায়, তাহলে বুঝবেন সেটা প্রতারণা।'
কেন মানুষ ভূতে বিশ্বাস করে?
বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে ভূতে বিশ্বাস করেন। হয়তো তাদের পরিবারে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, অথবা তারা কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি ঘুরে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করেছেন।
আবার মানুষের মানসিকতাতেও ব্যাখ্যাতীত জিনিসকে অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যায় ফেলে সান্ত্বনা খোঁজার প্রবণতা আছে। এজন্য বিশ্বাসযোগ্য করে মিথ্যা গল্পকে সবার কাছে বলে বেড়ান।
স্টিফেন হাফের ভাষ্য, 'অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাগুলো প্রায়ই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা হয়। অথচ সেগুলোর কোনো প্রমাণ নেই। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা মিথ্যাগুলোই তখন মানুষ বিশ্বাস করে। এভাবে অতিপ্রাকৃত গল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরে ছড়িয়ে আসছে।'
শেষ কথা
যদি ভূত থেকে থাকে এবং তারা এমন কোনো জৈবিক বা শক্তির রূপ হয় যা এখনো বিজ্ঞান শনাক্ত করতে পারেনি, তাহলে বিজ্ঞানীদেরই একদিন তা প্রমাণ করতে হবে। তবে শত শত বছর খোঁজাখুঁজির পরও আজ পর্যন্ত ভূতের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
মূলত ভূতের গল্প শোনায়, ভয় পাওয়ায় বা ভৌতিক বাড়ি ঘুরে বেড়ানোয় যে আনন্দ আছে—সেটাই হয়তো এসব মিথ ছড়ানোর আসল উদ্দেশ্য।
সবশেষে বলা যায়, ভূত নিয়ে মানুষের উৎসাহ অনেকাংশে কল্পনা ও সংস্কৃতির ফল—যা প্রমাণের নয়, গল্প করার জন্যই টিকে আছে।
Comments