সাগর-রুনি হত্যা

১১ বছর আগের কিছু স্মৃতি

খুব সাহস করে রুমটার দরজায় গেলাম। রক্তাক্ত। এলোমেলো কক্ষ। সাগর ভাইয়ের হাত-পা বাঁধা। রুনি আপার টি-শার্ট একটু উপরের দিকে উঠানো। রক্তের ধারা এরমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য! দুটো জলজ্যান্ত মানুষ লাশ হয়ে পড়ে আছেন।
সাগর-রুনি হত্যা
সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। ছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলার মূল অফিস কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনে। আর চ্যানেলটির নিউজরুম ওয়াসা ভবনের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ঢাকা ট্রেড সেন্টারের ৮ তলায়। এই চ্যানেলে আমি সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৩ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আমি সাংবাদিক মেহেরুন রুনির সহকর্মী ছিলাম। আমরা কিছু দিন একসঙ্গে কাজ করেছি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নির্মম মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তিনি আবার এটিএন বাংলায় যোগ দিয়েছিলেন। আবার বলছি কারণ স্বামী সাগর সরওয়ারের কর্মস্থল জার্মানিতে যাওয়ার আগে তিনি এটিএন বাংলাতেই কর্মরত ছিলেন। জার্মানিতে যাওয়ায় তার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে একটা ছেদ পড়েছিল। চ্যানেলটিতে সংবাদ সম্প্রচারের প্রথম দিককার কর্মী ছিলেন মেহেরুন রুনি।

২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল শুক্রবার। আমার নাইট ডিউটি ছিল। এটিএন বাংলার কাজের সূচি অনুযায়ী রাতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিবেদকরা রাত ১০টা থেকে অফিসে আসেন। তখন আমি থাকতাম মোহাম্মদপুরে। অবিবাহিত জীবন। বাসায় কোনো কাজ ছিল না, তাই ওই দিন বিকেলেই এটিএন বাংলা অফিসে চলে যাই। আর ওই দিনই মেহেরুন রুনির সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এটিএন বাংলার নিউজরুমে মেহেরুন রুনি আমার বসার জায়গার ২ সিট আগে বাম পাশে বসতেন। ছোট হিসেবে আমাকে বেশ আদর করতেন। শুধু আমাকেই নয়, অফিসের অন্য ছোটরাও তার আদর পেতেন। মন খোলা, প্রাণবন্ত একজন মানুষ। ওই শুক্রবার বিকেলে, হয়তো তখন সন্ধ্যা হবে হবে, এমন সময় তিনি এটিএন বাংলার নিউজ রুম থেকে বের হয়ে যান। তার শেষ চলে যাওয়া। শেষ প্রস্থান। আজও মনে পড়ে, হাতে ব্যাগ, শীতের কাপড় নিয়ে দ্রুত লয়ে চলে গেলেন রুনি আপা। বলে গেলেন, যাই রে!

বর্তমানে এসএ টিভিতে নিউজ এডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন ইলিয়াস হোসেন। তিনি চ্যানেল ওয়ানে আমার সহকর্মী ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে ইলিয়াস ভাই আমাকে ফোন করেন। বলেন, আপনি কোথায়? রাতের ডিউটি করে এসে আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কোনোমতে ফোনটা ধরে বলি, বাসায়। ছোট্ট করে বললেন, টিভি খোলেন। আপনাদের রুনি আপা স্বামীসহ খুন হয়েছেন। মোটামুটি এক লাফে টিভি রুমে গেলাম। দেখলাম লাল কালিতে ব্রেকিং নিউজ, পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি খুন। ওই বাসায় তখন থাকতো আমার সহপাঠী, দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদকর্মী সাইফুল সামিন। তাকে ডাকলাম। বললাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। টিভি দেখো। আমি বের হলাম।

বলা যায় প্রায় দৌড়ে গেলাম পশ্চিম রাজাবাজারের ওই বাড়িতে। দেখলাম এরমধ্যেই অনেক সহকর্মী চলে এসেছেন। এটিএন বাংলা ও মাছরাঙ্গা টিভির অনেকেই। জায়গাটা বেশ জনাকীর্ণ। ফ্ল্যাটে ঢুকে ড্রয়িং স্পেস পার হয়েই রুনি আপা ও সাগর ভাইয়ের কক্ষ। আমি মোটামুটি শক্ত নার্ভের মানুষ। মরদেহ দেখা আমার কাছে কঠিন কোনো কাজ নয়। খুব সাহস করে রুমটার দরজায় গেলাম। রক্তাক্ত। এলোমেলো কক্ষ। সাগর ভাইয়ের হাত-পা বাঁধা। রুনি আপার টি-শার্ট একটু উপরের দিকে উঠানো। রক্তের ধারা এরমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য! দুটো জলজ্যান্ত মানুষ লাশ হয়ে পড়ে আছেন। সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছিল। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশার গুণীজন, প্রচুর সাংবাদিক ভিড় করেছেন। পুলিশপ্রধান এলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও কত শত মানুষ।

রুনি আপার বাড়ি থেকে চলে আসি এটিএন বাংলার অফিসে। অফিস থমথমে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অফিস থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো মাছারাঙ্গা টিভিতে যাওয়ার জন্য। আমি একটা ইউনিট নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। গেলাম মাছরাঙ্গা টিভিতে। ওই টিভিতেও একই অবস্থা। শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। সাগর ভাইয়ের বসার চেয়ারের ছবি নিলাম। যেখানে তিনি গত রাতেও বসে কাজ করেছিলেন। কয়েকজন শোকার্ত সহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরলাম এটিএন বাংলায়। সাগর ভাইকে নিয়ে সংবাদ তৈরি করলাম। সম্প্রচার হলো দুপুর ২টার নিউজে। আসর নামাজের পর রুনি আপার মরদেহ এটিএন বাংলার সামনে আনা হলো। জানাজা হলো। তারপর বিকেলের শেষ আলোয় তাকে আমরা শেষ বিদায় জানালাম।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অতি আলোচিত ঘটনা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড। মানুষের প্রত্যাশা ছিল এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য মানুষ দ্রুতই জানতে পারবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে। কিন্তু হায়! অতি সংবেদনশীল এই ঘটনা নিয়ে শুরু হলো এক লঙ্কাকাণ্ড। রুনি আপার চরিত্র হনন, এটিএন বাংলার কয়েকজন সহকর্মী ও রুনি আপাকে জড়িয়ে সংবাদ, জ্বালানি খাতের সংবাদ প্রকাশের আক্রোশ থেকে হত্যাকাণ্ডসহ কত কী! এমনকি আমি নিজেও এই হত্যাকাণ্ডের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, এমন কথাও মানুষের কাছ থেকে শুনেছি। প্রকৃত রহস্য ভেদ না হওয়ায়, নানা সন্দেহ, নানা গল্প, নানা তত্ত্ব এই ঘটনাকে এতটাই রহস্যঘেরা করে তুলেছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য আদৌও ভেদ হবে কি না, তাই বড় সন্দেহ।

 

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago