স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন: এক দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা
সদ্য স্বাধীন দেশ। কিংবদন্তি স্থপতি মাজহারুল ইসলাম দেখা করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তার সঙ্গে এক তরুণ স্থপতি মুক্তিযোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের একপর্যায়ে মাজহারুল ইসলাম সেই তরুণকে সামনে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'এই তরুণ আর্কিটেক্ট মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এদের দিয়েই এখন দেশের কাজ করাতে হবে।'
বঙ্গবন্ধু সেই তরুণ স্থপতির পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বললেন, 'বাবারা! শুধু ঢাকা শহর নিয়ে প্ল্যান করলে হবে না। সারা বাংলাদেশ নিয়ে প্ল্যান করতে হবে।'
সেদিনের সেই তরুণ স্থপতি জীবনভর বঙ্গবন্ধুর সেই অনুরোধটি পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে।
সেই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তাকে আসলে ঠিক কতো অভিধায় রঞ্জিত করা যায় তা জানা নেই। জীবনের প্রথমভাগে তিনি অংশ নিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন সমস্ত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রভাগের সৈনিক হিসেবে। নাগরিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান মুখ।
একজন স্থপতি হিসেবে তিনি যেমন স্বাক্ষর রেখেছেন পেশাগত জীবনে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে গণমানুষের অধিকারে সবসময়ই ছিলেন সোচ্চার। নৈতিকতার প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন, মানবতার প্রশ্নে ছিলেন চির কোমল। তিনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষ।
সব কিছুর বাইরে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বরাবরই ছিলেন পাদপ্রদীপের বাইরে। আপন মাতৃভূমিকে তিনি কেবল দিয়েই গেছেন। বিনিময়ে কিছু ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা করেননি।
ছাত্রাবস্থায় থেকেই রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন। সেসময় যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে। বুয়েটে পড়াকালে তার রুম ছিল রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়। হুলিয়া মাথায় নিয়ে তার রুমে আশ্রয় নিয়েছিলেন কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাইফউদ্দীন আহমদ মানিকের মতো প্রখ্যাত রাজনীতিবিদরা।
ছাত্রাবস্থাতেই বুয়েটে তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে হলের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে।
জন্মেছিলেন অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে। জন্মের ৩ বছরের মাথায় হারান বাবাকে। এরপর নানাবাড়িতে তার বেড়ে উঠা। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভীষণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। ছাত্রজীবনেই স্বাবলম্বী হতে নিজেই ট্রাকের ব্যবসায় নেমেছিলেন। চাইলে তিনি বিলেতের স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনও বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু, কখনোই তিনি তা চাননি।
২৩ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধের আগ মুহূর্তে লন্ডন যাওয়ার সময় মোবাশ্বের হোসেনের মা চেয়েছিলেন দেশের এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে ছেলে যেন তার সঙ্গে লন্ডনে চলে যান। মায়ের অনুরোধের পরও বিদেশে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপনের প্রতি আগ্রহী হননি তিনি।
মোবাশ্বের হোসেনের পেশাগত জীবন, গণঅধিকারের আন্দোলন ও নানান সাংগঠনিক ভূমিকা নিয়ে সবসময়ই আলোচনা হয়। তিনি রণাঙ্গনে ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম গেরিলা ছিলেন—তা চিরকাল আড়ালেই থেকে গেছে। এই পরিচয়টি নিয়ে নীরবে গর্ববোধ করলেও কখনোই তা প্রকাশ্যে আনেননি।
বিনয়ী এই মানুষ রণাঙ্গনের যোদ্ধা হয়েও কখনোই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি। স্পষ্ট ভাষায় বলতেন 'মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলাদাভাবে সরকানি স্বীকৃতি নেওয়ার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।'
এর পিছনে লুকিয়ে আছে করুণ গল্প। একবার মোবাশ্বের হোসেন মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিতে গিয়ে দেখলেন এক স্বাধীনতাবিরোধীও সনদ পেয়েছেন। এরপরই সরে আসেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ওয়ারীর বাড়িতে রেখে সব মায়া ঠেলে মোবাশ্বের হোসেন যুদ্ধে যোগ দেন। জুলাইয়ে দেশের ভেতরেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ক্র্যাকপ্লাটুনের হয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রমের নেতৃত্বে একের পর এক দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশ নেন মোবাশ্বের হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর রক্ষাকবচ হিসেবে নিজের শিশু সন্তানকে বেছে নেওয়ার অপূর্ব এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তিনি। সেসময় প্রায়শই গোপীবাগের বাড়িতে আসতেন মোবাশ্বের হোসেন। তাদের পাশের বাড়িতেই ছিল এক গোঁড়া মুসলিম লীগ সমর্থকের বাড়ি। সেখানে নিয়মিত আসতো জেনারেল নিয়াজীও। যখনই ওই বাড়িতে জেনারেল নিয়াজি আসতো তখনই শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে রাস্তায় নামিয়ে তিনি দেখার চেষ্টা করতেন যে শিশুসন্তানকে ফেলে তার যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব না।
মুক্তিযুদ্ধে মোবাশ্বের হোসেনের গোপীবাগের বাড়িটি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখার নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
ডিসেম্বরে ক্র্যাকপ্লাটুনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাকায় আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইউসিস (ইউএসআইএস) ভবনে গেরিলা হামলা চালানো হবে। এটি ছিল বর্তমান জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশে।
যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে যেহেতু সরাসরি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে তাই ইউসিএস ভবনে অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয় গেরিলা মোবাশ্বের হোসেনকে। সে সময় ভবনটি খুবই সুরক্ষিত ছিল। ২ ভবনের মাঝখানে নিরাপত্তারক্ষীরা সবসময় মেশিনগান নিয়ে পাহারা দিতেন।
অপারেশনের আগে সে জায়গা ২ দফা রেকি করা হয়। দেখা যায় অপারেশন করলে ১০-১২ জন মারা যাবে। আর কোনো বিকল্প নেই। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই অপারেশন চালানোর বিষয়ে একমত হলেও মোবাশ্বের হোসেন কিছুতেই মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন অপারেশনটি যেমনই হোক কোনো নিরীহ মানুষ যেন মারা না পড়ে।
তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন গেরিলা মানু। তারা সিদ্ধান্ত নেন—এমনভাবে অপারেশন চালাতে হবে যাতে একজনও নিহত না হন।
কিন্তু তা কীভাবে। মোবাশ্বের হোসেন বললেন, 'আমরা আগে সব লোক ইউসিস ভবন থেকে বের করে দিবো।'
জবাবে মানু বললেন, 'লোক বের করতে হলে তো আপনাকেই গুলি করে মারবে।'
মোবাশ্বের হোসেন বললেন, 'আমি সেই ঝুঁকিটা নিবো।'
এরপর তারা ২ জনে রমনা থানার সামনে গাড়ি ঠিক করার ভঙ্গিতে গাড়ির নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে নিলেন। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল অপারেশনে অংশ নিবেন গেরিলা মানু, ফুলু, জিয়াউদ্দিন ও মোবাশ্বের হোসেন নিজে। বিস্ফোরণ ঘটাবেন মোবাশ্বের হোসেন। বাকিরা থাকবেন পাহারায়। তিনি অস্ত্র নিয়ে তাকে কভার করবেন।
১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ইউসিস ভবনে অপারেশনের সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে তারা কোট পরে ভিতরে ঢোকেন। কোটের নিচে স্টেনগান। তারা ঢুকেই দেখলেন ১৫-২০ জন লাইব্রেরিতে বসে পড়ছে। স্টেনগান বের করার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে সবাই হাত উপরে তুললেন। উপস্থিত সবাইকে মুহূর্তের মধ্যেই বের করা হলো। তারা সরে যাওয়ার পর ডেটোনেটর কর্ডে আগুন দিলেন মোবাশ্বের হোসেন। দেখা গেল আগুন জ্বলছে না।
একবার ডেটোনেট করার পর দ্বিতীয়বার আগুন জ্বালালে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কিন্তু ডেটোনেটর কর্ডে আগুন না লাগায় অধিক উত্তেজনায় ঝুঁকি নিয়ে দ্বিতীয়বার আগুন জ্বালালেন মোবাশ্বের হোসেন। এরপরই ডেটোনেটর ছুঁড়ে গাড়িতে উঠে যখন বসবেন তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলো।
অপারেশন করেই গোপীবাগের বাড়িতে চলে গেলেন তিনি। বাড়িতে পৌঁছেই শিশু সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন যেন ঘুণাক্ষরেও কেউ টের না পায় অপারেশনটি চালিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকা শহরে সকাল বেলায় চালানোর এই অপারেশন তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে প্রতিবারই অজানা এক ছেলেকে স্মরণ করতেন মোবাশ্বের হোসেন। সে ছেলেটি তাদের অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে সাহায্য করেছিল। এটি ইউসিস ভবনে অপারেশনের কয়েকদিন আগের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ঢাকায় প্রবেশ করতো যাত্রাবাড়ির মানিকনগরের আশেপাশের গ্রাম দিয়ে।
গোপীবাগ রেলগেট পর্যন্ত তার এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসার কথা। রাস্তার অপর পাশ পর্যন্ত অস্ত্রও নিয়ে আসা হলেও সুযোগের অভাবে অস্ত্র শহরে ঢোকাতে পারছিলেন না মোবাশ্বের হোসেনরা। মোবাশ্বের হোসেন তখন অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। হঠাৎ ১০ বছরের এক বালক তাকে জিজ্ঞেস করলো কিছু আনতে হবে কিনা। প্রথমে এর অর্থ বুঝতে পারেননি তিনি। তিনি হাঁটা শুরু করলে বালকটিও তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলে, কোনকিছু আনা দরকার হলে তাকে যেন জানায়।
মোবাশ্বের হোসেন দেখলেন বন্ধুটি যেহেতু আসেনি সুতরাং তাকে যেভাবেই হোক ২ দিনের মধ্যে অস্ত্রগুলো শহরে আনতেই হবেই। তাই তিনি অপারগ হয়ে ছেলেটির সাহায্য চাইলেন। ছেলেটিকে নিজের বাসা ও অস্ত্রের ভাণ্ডার দেখিয়ে দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর বিস্ময়ের চোখে মোবাশ্বের হোসেন দেখলেন ছেলেটা ব্যাগে অস্ত্র নিয়ে এর ওপর ডাঁটা শাক পেঁচিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে গান গাইতে গাইতে মানিকনগর থেকে তার বাসায় অস্ত্র পৌঁছিয়ে দিলো।
যতবারই ইউসিস ভবনের অপারেশনের কথা বলতেন ততোবারই মোবাশ্বের হোসেন অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করা অচেনা সেই বালককে স্মরণ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, 'আজো আমি ওই ছেলেকে খুঁজছি। মানিকনগরের ওই মানিককে আজো খুঁজে পাইনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা তো অনেক বাগাড়ম্বর করি। কিন্তু এই ছেলেটির মতো লোকদের অবদানের কথা বলি না। আমার নিজের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান তার শতগুণ করলেও এই ছেলেটির অবদানের সমান হবে না।'
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে কর্মজীবনে চাইলে মোবাশ্বের হোসেন সরকারি চাকরির মতো নির্ঝঞ্ঝাট চাকরিজীবন ও বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে মাত্র দেড় মাস চাকরি করেই ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। যদিও তিনি আর পদত্যাগপত্রটিও জমা দেননি।
তার চাকরি ছাড়ার প্রধান কারণ ছিল 'অফিসে পিয়নকে সন্তানের দুধ কেনার জন্য ছুটি দিয়েছিলেন তিনি। যার দরুণ তাকে ৩ দিন ধরে রিপোর্ট লিখতে হয়েছে। পদত্যাগপত্র জমা না দেওয়ায় মোবাশ্বের হোসেনের পরে কখনো সরকারি চাকরি করতে পারবেন না বলেও হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেই হুমকির কোনো তোয়াক্কা করেননি।
ছোটবেলা থেকেই অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা বিদ্যমান ছিল মোবাশ্বের হোসেনের। আমৃত্যু সেই দক্ষতার পরিচয় তিনি রেখেছেন নানান ক্ষেত্রে। কিশোর বয়সে বগুড়ায় নানা বাড়ির একাংশে ক্লাব তৈরির মধ্য দিয়ে তিনি যে সংগঠকের পরিচয় রেখেছিলেন তা পরবর্তীতে আরও শাণিত হয়েছে। নানা ক্ষেত্রে তিনি একের পর এক সংগঠন তৈরি করেছেন।
পরিবেশ রক্ষার তাগিদে যেমন তার হাতে জন্ম হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা)। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার হাতে জন্ম হয় সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের, ভোক্তা অধিকারের স্বার্থে গড়েছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব), স্থপতি ইনস্টিটিটিউটেও তিনি দেখিয়েছেন অসীম দক্ষতা।
কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস ও আর্ক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পেশাগত জীবনে বরেণ্য স্থপতি হিসেবে যেমন প্রসিদ্ধ ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন ঠিক তেমনি দেশসেবায় ছিলেন অবিচল। স্থাপত্য শিল্পে তার সৃষ্টি কতটা নান্দনিক তার প্রমাণ চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের অপূর্ব নকশা কাঠামো। যেখানে তিনি ভবনের গৎবাঁধা নকশার চেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রাণ সঞ্চার করাকে। একই উদাহরণ তার নকশায় করা মিরপুরের প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক ভবনও।
স্থপতি হলেও পরিবেশ নিয়ে আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন। পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন।
নৈতিকতার দিক থেকে মোবাশ্বের হোসেন আজীবনই প্রশ্নাতীত সততা বজায় রেখেছিলেন। একবার গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে তিনি ভোক্তা অধিকার নিয়ে মামলা করেছিলেন। মামলার পরপরই গ্রামীণফোনের তৎকালীন এমডি ইকবাল কাদির গ্রামীণফোনের উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের অফিসে।
উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মোবাশ্বের হোসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে টেলিফোন করে বললেন, 'দেখেন, গ্রামীণফোন থেকে আমাকে ঘুষ দেওয়ার জন্য আসছে।'
মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন ক্রীড়ামোদীও। সমস্ত নাগরিক অধিকারে বিষয়ে প্রথম সারির সৈনিক ছিলেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। একই সঙ্গে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধেও করেছেন একাধিক মামলা। প্রতিটি মামলায় তিনি জয়ী হওয়া সত্ত্বেও চেম্বার জজের মাধ্যমে একের পর এক তা স্থগিত করা হয়েছে।
ব্রাদার্স ইউনিয়নে সভাপতি থাকা অবস্থাতেই মোবাশ্বের হোসেন দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্লাবের খেলোয়াড়দের জন্য ইনস্যুরেন্স চালু করেছিলেন। ক্লাবে হাউজি ও জুয়ার আসর বন্ধের জন্য সমপরিমাণ টাকা নিজের পকেট থেকে ক্লাবের ফান্ডে দিয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে তার ছিল নিরন্তর প্রচেষ্টা।
১৯৯৬ সালের ঘটনা। পরিচালক পদপ্রার্থী হয়ে বিসিবি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন মোবাশ্বের হোসেন। পরদিন পত্রিকায় খবর বের হয়—নির্বাচনে চরম দুর্নীতি ও অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। সেদিন দুপুরেই বিসিবি সভাপতি বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন মোবাশ্বের হোসেন।
পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছিলেন, সংবাদমাধ্যমে নির্বাচন সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তিনি এর প্রতি আস্থা রেখে মনে করছেন জরুরিভিত্তিতে বিসিবির উচিৎ এই নিয়ে তদন্ত করা। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থেই তিনি পদত্যাগ করেছেন।
মোবাশ্বের হোসেন বাদে সব পরিচালকই পদত্যাগ তো দূরের কথা নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তার সেই পদত্যাগের খবর পরদিন আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মৃত্যুর ৮ মাস আগে রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে তিনি সর্বদাই ছিলেন স্থানীয়দের পাশে। ঠিক তেমনি ধানমন্ডি মাঠ সবার জন্য খোলা রাখতে তার অবিরাম প্রচেষ্টা ছিল। মোবাশ্বের হোসেনের নামে মামলা করতেও দ্বিধা করেনি লেফটেনেন্ট শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। তাসত্ত্বেও চুল পরিমাণও ছাড় দেননি মোবাশ্বের হোসেন।
তারুণ্যে মোবাশ্বের হোসেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য। ঠিক তেমনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরও তার নশ্বর দেহ যেন তরুণ চিকিৎসকদের কাজে লাগে। মৃত্যুর আগেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেহ দান করেন।
মোবাশ্বের হোসেনের মনোজগৎ জুড়েই ছিল এদেশের মাটি ও মানুষ। দেশ এগিয়ে যাবে এই ছিল তার স্বপ্ন ও আশাবাদ। এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকর্তা তাকে 'কখনো হতাশা কাজ করে কিনা' জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, 'ধরুন আগ্নেয়গিরির আগুন দগদগ করছে। কেউ ফুটো করেনি বলে আগুন বাইরে আসতে পারেনি। কিন্তু কেউ না কেউ ফুটো করবে। ক্ষুদিরামকে কী কেউ বলেছিল যে, তুমি বোমা ফাটালে দেশ দুই দিনের মধ্যেই স্বাধীন হবে। কিন্তু আমি মনে করি, ক্ষুদিরামের অবদানের জন্য দেশ এক ঘণ্টার জন্য হলেও আগে স্বাধীন হয়েছে। আমার কোনো কাজে দেশ এক ঘণ্টার জন্যও যদি আগে উন্নত হয় সেটাই আমার অর্জন। রাতারাতি পরিবর্তন হতে চাওয়াটাই বোকামি। একটি গাছ লাগিয়ে ফল পেতে হলে সময় দিতে হবে।'
বাংলাদেশ নিয়ে ভীষণ আশাবাদীও ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন। বলতেন, 'আমি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত সম্ভাবনাময় দেশ কোথাও নেই।'
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম থেকে সব নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিঃসন্দেহে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের অবদান থাকবে চিরভাস্বর হয়ে। শারীরিকভাবে প্রস্থান হলেও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের কীর্তি ও সংগ্রামী অভিযাত্রা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের বুকে।
সূত্র: সাক্ষাৎকার: 'রূপালি আগুন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন'/ শুভ কিবরিয়া: সাপ্তাহিক, ৯ আগস্ট ২০১২
Comments