সিতারা আপার স্মৃতি

শিক্ষক কোথায় থাকেন? একজন শিক্ষকের বাস কোথায়? এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদ তোফাজ্জল হোসেন।
অধ্যাপক সিতারা পারভীন। ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

শিক্ষক কোথায় থাকেন? একজন শিক্ষকের বাস কোথায়? এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদ তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বগুড়ার একজন কীর্তিমান শিক্ষক ও লেখক। ব্যক্তিগত এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, 'একজন শিক্ষক থাকেন শিক্ষার্থীর হৃদয়-নিভৃতে।'

হৃদয়রন্ধ্রের অতি সংবেদনশীল স্থানে শিক্ষকের বাস। শিক্ষকের নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও তিনি অনন্তকাল বাস করেন হাজারো শিক্ষার্থীর হৃদয় গহীনে। সযত্নে, উষ্ণতায়। যদিও সব শিক্ষকই এই সম্মানের যোগ্য নন। যেসব শিক্ষক সংবেদনশীল হৃদয়ে প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও পরামর্শ দিয়ে শিক্ষার্থীর জীবনকে আলোকিত করেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ বাতলে দেন, সংকটে স্নেহের পরশ নিয়ে পাশে দাঁড়ান, তাদের ভাগ্যেই জোটে এই সম্মানের সিংহাসন।

নিশ্চিতভাবেই সবাই এই কাতারের নন। আজকের আলোচনা হাজারো শিক্ষার্থীর হৃদয়-গহীনে বাস করা এক শিক্ষককে নিয়ে। যদিও তিনি এখন দূর আকাশের উজ্জ্বল সিতারা, তিনি অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন।

২০০৫ সালের জুন মাস। অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়াবলীর পরীক্ষা ছিল খুব সম্ভবত ৭ বা ৮ জুন। পরীক্ষার আগে প্রবল জ্বরে পড়লাম। জ্বর মানে ১০৩-১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আবাসিক হলে থাকি। সেবা-শুশ্রূষার কেউ নেই। খাওয়া-দাওয়াও যা-তা। এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়লাম যে কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। একটু পরপর চোখে ঝাপসা দেখি, মাথা ঘুরায়। গায়ে জ্বর নিয়েই পরীক্ষার হলে গেলাম। চেহারা ফ্যাকাসে, শরীর ভয়াবহ দুর্বল।

পরীক্ষা শুরু হলো। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় দায়িত্বরত বিভাগীয় শিক্ষক কাছে এলেন। বললেন, 'এই তুমি কি অসুস্থ!' বললাম, 'আপা কয়েকদিন ধরেই আমার বেশ জ্বর।' তিনি ভীষণ যত্নের সঙ্গে বললেন, 'মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করো। অতিরিক্ত কাগজ লাগলে তোমার ওঠার দরকার নেই। আমার দিকে তাকিয়ো, আমি দিয়ে যাবো। আর যদি পানি পান করার দরকার হয়, ওষুধ বা অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, আমাকে জানাবে। তুমি পরীক্ষা দাও।' পুরো পরীক্ষার সময় আপা আমার আশেপাশে থাকলেন। মনে হলো, তিনি অপেক্ষায় আছেন, কখন কীভাবে আমাকে একটু সাহায্য করা যায়। পরীক্ষা শেষে আপাকে সালাম দিয়ে চলে এলাম।

হায়! সেটাই ছিল আপার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। এরপর ১৮ জুন অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন একটি অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র গেলেন। ২৩ জুন শিকাগোতে এক সড়কের বাঁকে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তিনি চলে গেলেন অন্য ভুবনে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এনটিভির খবরে আপার মৃত্যুর বিস্তারিত জানলাম। ওই দিনই প্রথম জানতে পারলাম অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের মেয়ে।

চালচলন, আচার-ব্যবহারে কোনো দিন প্রকাশ পায়নি যে তিনি রাষ্ট্রের এতো গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তির সন্তান। স্পষ্ট মনে আছে, ক্যাম্পাসে আসতে আপা ব্যবহার করতেন মরিস মাইনরের অত্যন্ত পুরাতন ও জরাজীর্ণ মডেলের একটি গাড়ি। এমন গাড়ি দেশের প্রধান বিচারপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতির মেয়ে ব্যবহার করেন, বিষয়টি ছিল রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এই মরিস মাইনর গাড়িটি ছিল বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমেদের। পৈত্রিকসূত্রে আপা গাড়িটি পেয়েছিলেন। যতদূর জেনেছিলাম এটাই ছিল আপার পরিবারের একমাত্র গাড়ি।

একটু পেছন দিকে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আমাদের ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের এপ্রিলে। প্রথমবর্ষের ক্লাসেই আমরা তাকে ক্লাসে পেয়েছিলাম। যদিও পুরোপুরি এক বছর বলা যাবে না। কারণ, ২০০৪ সালে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। প্রায়ই হরতাল-অবরোধ থাকতো। এ ছাড়া, ওই বছরের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল। তাই বলা যায় আমরা অনেক কম সময় আপাকে পেয়েছিলাম। এই সময়ই তিনি আমাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়াবলী কোর্সে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বিস্তারিত পড়িয়েছিলেন। অত্যন্ত আদুরে কণ্ঠে, নিম্নস্বরে তিনি আমাদের সামনে নানা সংবেদনশীল বিষয়গুলো তুলে ধরতেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে এক আলাপচারিতা ২০০৩-২০০৪ ব্যাচের সবার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। আমাদের ব্যাচের খুবই আমুদে, কিছুটা দুষ্টু প্রকৃতির সহপাঠী ছিলেন মামুনুর রশিদ মামুন। ক্লাসে আপা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বদরুদ্দীন উমর কে? মামুন কিছুটা দুষ্টামির ছলেই উত্তর দিয়েছিলেন, বদরুদ্দীন উমর আল-বদর বাহিনীর প্রধান!

বিষয়টি নিয়ে বেশ হাস্যরসের পর আপা মামুনকে বড় একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেছিলেন। মামুন লেগে পড়লেন অ্যাসাইমেন্ট তৈরিতে। পরে বিষয়টি নিয়ে ক্লাসে আলাপ হয়েছিল। একই টপিকে একবার ক্লাসে আপা আলাপ করেছিলেন ১৯৭১ সালে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড দ্য বিটলস্ এর মানবতাবাদী কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নিয়ে। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারের ওই কনসার্টের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ শিরোনামের গানটি। জর্জ হ্যারিসনের লেখা ও গাওয়া এই গানটি আমি একটু একটু গাইতে পারতাম। ক্লাসে এই বিষয়ে এক মিথস্ক্রিয়ার পর আপা আমাকে গানটি গাইতে বলেছিলেন।

বেসুরা কণ্ঠে আমি কয়েক লাইন গেয়েছিলাম। গানটি গাওয়ার পর আপা বলেছিলেন, আমার ক্লাসে কী ব্রিলিয়ান্ট ছেলে একটাই! ২০০৫ সালে এই মহানগরীতে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতাসহ নানা সংকটে ভুগতে থাকা একজন শিক্ষার্থীর কাছে 'ব্রিলিয়ান্ট' শব্দটি ছিল এক বিরাট সঞ্জীবনী শক্তি। যে শক্তি আমাকে অনেক বাঁধা জয় করতে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।

আপার মৃত্যুর পর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চালু হয়েছে অধ্যাপক সিতারা পারভীন পুরস্কার। স্নাতক পর্যায়ে ভালো ফলাফলের জন্য শীর্ষ মেধাবী শিক্ষার্থীর এই পুরস্কারটি পেয়ে থাকেন। আমি যতদূর জানি, মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপার যত অর্থ প্রাপ্য ছিল, তা দিয়েই এই পুরস্কারের ফান্ড গঠিত হয়। যা আজও বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্মানিত করে আসছে।

অধ্যাপক সিতারা পারভীন পুরস্কারপ্রাপ্ত এক শিক্ষার্থী ছিলেন কাজী এম. আনিসুল ইসলাম। এক অনুষ্ঠানে তিনি তুলে ধরেছিলেন ঠিক কীভাবে, এক গভীর সংকটে এক শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক সিতারা পারভীন। কীভাবে এক শিক্ষার্থীর জীবনের মোড় তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, তা অত্যন্ত সরল ভাষায় তুলে ধরেছিলেন বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী এম. আনিসুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কি শুধুই পাঠদানের পেশাদারিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি শিক্ষকরা স্নেহশীল অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আছে ভিন্ন মত। এ বিষয়ে ভালো-মন্দ উদাহরণও আছে। স্বাস্থ্যকর বিতর্ককে সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, শিক্ষকরা খুব সম্ভবত শুধুই ক্লাসের শিক্ষক নন, তারা এক অর্থে অভিভাবকও। যাদের স্নেহমাখা পরামর্শ, শাসন আর দিক-নির্দেশনা অনেকেরই জীবন বদলে দিতে পারে। হতে পারে সংকটের সহায়।

অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীনের সঙ্গে আমার যে সামান্য স্মৃতি, তা একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক ও স্নেহশীল অভিভাবকের। আমি আজও সবসময় পরিপাটি, সময় মেনে ক্লাসে আসা স্নেহশীল আপাকে অনুভব করি। জানি না, ১৯ বছর পর আমার বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আজও অধ্যাপক সিতারার মতো দায়িত্বশীল, স্নেহশীল ভূমিকা পালন করেন কি না? হয়তো সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের ধরণ।

পুনশ্চ এই নিবন্ধে উল্লেখিত আমাদের সহপাঠী সাংবাদিক মামুনুর রশীদ মামুনও ২০১৮ সালে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। মামুন, তোর সঙ্গে কি আপার দেখা হয়? হলে বলিস, আমরা এখনও আপার শূন্যতা অনুভব করি।

শ্রদ্ধা জানবেন প্রিয় আপা, অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন।

 

রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

3h ago