শিক্ষকতায় আনন্দ-বৈচিত্র্য

শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর সঙ্গে নাদিয়া রহমান। ছবি: সংগৃহীত

খুব ছোটবেলা থেকেই চাইতাম, শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, গবেষণা নিয়ে আলোচনায় থাকবার। শিক্ষকদের বুকশেলফে রাখা সারি সারি বই আমাকে টানতো। 

নিজে শিক্ষক পরিবারের না হলেও আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তাই বেড়ে উঠবার জন্য বই, লেখালেখি, চিন্তাভাবনার একটা পরিবেশ সব সময়েই ছিল ঘরে। অনেক বান্ধবীদের মাতা-পিতাকে দেখেছি, বেশ বড় চাকরি করেন, উচ্চশিক্ষিতও বটে। কিন্তু মেয়ে সন্তানকে 'মেয়ে সন্তান' হিসেবেই দেখতেন, একজন সন্তান হিসেবে দেখতেন না। আমি গর্বিত আমার মাতা-পিতা এতটা উচ্চশিক্ষিত না হলেও তারা স্বশিক্ষিত এবং উদার মনের। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র বছরগুলোয় যখন গবেষণার কেবলমাত্র হাতেখড়ি, তখন থেকেই ঘণ্টার পড় ঘণ্টা গবেষণা প্রবন্ধ, জার্নাল আর্টিকেল পড়ার মধ্যে আমার আনন্দ কাজ করতো। আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম এসব পাতায় মুখ ডুবিয়ে। তখন থেকেই প্রার্থনা করতাম, এই পরিবেশেই যাতে বিশ্ববিদ্যালয় শেষেও আমি থাকতে পারি। 

আশপাশের অনেকেই ঠাট্টা করতো, যে কাজ মানুষের বিরক্ত লাগে সে কাজে আমার মধ্যে কেন এত ভালো লাগা তৈরি করবে? বা এখনো শুনি, দেশের শিক্ষকতা এমন কী! একটা সময় খারাপ লাগলেও যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য এসে সেই খারাপ লাগা বোধটাও চলে গেছে। এখানে কেউ কারও পরিচিতি নিয়ে দ্বিধাবোধ করে না। যে পড়তে ভালবাসে সে নির্বিকারে স্বীকার করে, সে দিনের কত ঘণ্টা এর পিছে ব্যয় করল। আবার যে খেলাধুলা করতে পছন্দ করে, সেও সরল স্বীকারোক্তি করে কতটা সময় ব্যয় করল তার পছন্দের কাজে। আজকাল প্রায়ই দেখি, পড়াশোনা করা বিষয়টাকে উপহাস বা ব্যঙ্গার্থকভাবে দেখা হয়। এর পেছেনে যে সমাজের রাজনৈতিক-অর্থনীতি কাজ করে তা বুঝতে বাকি কোথায়! 

আসলে সবার যা বিরক্ত লাগে আমারও সেই একই বিষয় কেন বিরক্ত লাগতে হবে? বৈচিত্র্য নিয়েই তো জগত বেঁচে থাকে। একজন ভালো গবেষক বা যে কোনো কাজেই সর্বোচ্চ পেতে হলে ঠিক একই পরিমাণ দিতেও হয়। সেটা ক্যারিয়ারের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই সত্য। এখানে আমাদের বিভাগের প্রধান ড. লিমপেরোস বলেন, 'সাফল্যের তো কোনো সহজ উপায় নেই!'

দেশে শুধু শিক্ষকতা না, পুরো কাঠামোই একই গতিতে চলছে, সেখানে আমাদের যার যার নিজের যে শ্রমসাধ্য গবেষণা তা ফেলনা নয়। ফেলনা হলে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বহির্বিশ্বের অধ্যাপকদের সামনে আমিই উপস্থাপন করতে পারতাম না। আমার গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন আছে বিধায়ই আমি এখানকার অধ্যাপকদের কাছেও প্রশংসা পাই; যে আগামী উচ্চশিক্ষার জন্য তুমি যথেষ্ট উপযুক্ত, বা অন্যদের থেকেও বেশ ভালো। এমন একটা পরিবেশে অন্তর্ভুক্ত না হলে হয়তো এতদিনের এত পাবলিকেশন, এত আগ্রহ আমার গড়ে উঠত না। 

অনেকেই বলে শিক্ষকতা একঘেয়ে, এখানকার অধ্যাপকদের লাইফস্টাইল কিংবা দেশের কয়েকজন শিক্ষকে দেখেও আমার তা মনে হয়নি। বরং সকাল ৮টা-৫টা অফিস, অন্যের প্রোফিটের জন্য কাজ করাটা আমার একঘেয়ে লেগেছে। সেখানে আমার গবেষণা আমারই সৃষ্টি। কারও কোনো দাবি নেই! আমারও মনে হয়েছে, যে কাজে সৃষ্টিশীলতা নেই, তাই তো বরঞ্চ একঘেয়ে। উল্টো মনে হয়েছে, যারা এমনটি বলেন তাদের স্যাম্পল, দৃষ্টিসীমা খুব সীমিত।
 
দিন শেষে, যার যে বিষয় ভালো লাগে তাই জীবিকা হিসেবে পেয়ে, নিজেকে গড়ে তোলাই নতুনত্ব!

 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English
National election

Political parties must support the election drive

The election in February 2026 is among the most important challenges that we are going to face.

11h ago