যে ৫ কারণে তুরস্ককে প্রয়োজন ইউরোপের

ছবি: রয়টার্স

ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্ব ওসমানীয় খেলাফতের সময় থেকেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্ক পশ্চিমমুখী নীতি মেনে নিলেও গত কয়েক দশকের ক্রমাগত চেষ্টার পরও দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেনি।

কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কারণে পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন গত ২ দশকে আঙ্কারার রেসিপ এরদোয়ান সরকারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুললে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের দেশগুলো তথা ইউরোপের সঙ্গে বেড়ে যায় তুরস্কের বাণিজ্যিক ও মতাদর্শগত দূরত্ব।

পরিবর্তিত বিশ্ব বা চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আলোচনায় এসেছে তুরস্ক। এশিয়া-ইউরোপের সংযোগস্থলের এই দেশটির ওপর আফ্রিকাসহ ৩ মহাদেশের নির্ভরতা আছে।

তুরস্কের ওপর ইউরোপের নির্ভরতার ৫ দিক নিয়ে গতকাল বুধবার জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে এর ইংরেজি সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম প্রধান সদস্য তুরস্কের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে এক সময় 'ইউরোপের রুগ্ন মানুষ' হিসেবে তিরস্কৃত তুরস্ককে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম 'ক্রীড়নক' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন অনুসারে তুরস্কের ওপর ইউরোপের নির্ভরতার ৫ দিক তুলে ধরা হলো:

মস্কো-কিয়েভের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী

ইউক্রেনে রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযান' বা ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাসীর জন্য নানান দুর্ভোগ বয়ে আনলেও তা তুরস্কের জন্য বয়ে এনেছে এক অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সুযোগ। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের শুরু থেকেই তুরস্ক বিবদমান দেশ ২টির মধ্যে শান্তি আনতে একমাত্র গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী হওয়ায় রাশিয়া ও ইউক্রেন—উভয়ের সঙ্গেই আঙ্কারার সম্পর্ক ভালো। এমন সম্পর্ক অন্য দেশগুলোর না থাকায় এরদোয়ান সরকারের ওপর মস্কো ও কিয়েভের আস্থা তুলনামূলকভাবে প্রবল।

এই সম্পর্কের জোরেই গত জুলাইয়ে তুরস্কের মধ্যস্থতায় জাতিসংঘকে নিয়ে ইস্তানবুলে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার রপ্তানি চুক্তি হয়।

এ ছাড়াও এখন পর্যন্ত তুরস্ক যুদ্ধরত ২ দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে অগ্রগণ্য হয়ে আছে।

ন্যাটো সম্মেলনে এরদোয়ান। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ন্যাটোয় তুরস্কের অবস্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব ২ মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়লে তুরস্ক ১৯৫২ সালে ন্যাটোয় যোগ দেয়। এই জোটে যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি সেনা তুরস্কের। তাই এ দেশটির প্রভাব প্রবল।

সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসনের আশঙ্কায় সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হতে চাইলে তুরস্ক দেশটির বিদ্রোহী কুর্দিদের 'সমর্থন' দেওয়ার অভিযোগে তা আটকে দেয়। এরপর থেকে উত্তর ইউরোপের এই দেশ ২টি আঙ্কারার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই তুরস্কের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

কম দামে ভালো প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম

গত ২ দশকে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেসিপ এরদোয়ানের রাজনৈতিক মতপার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় তুরস্কের ওপর এক সময়ের মিত্রদেশগুলোর সামরিক নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। এরপর দেশটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের ওপর মনোযোগ দেয়।

তুরস্কের তৈরি 'বেরাকতার' ড্রোন সম্প্রতি নাগোর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে বাকুর পক্ষে বেশ সাফল্য এনে দেয়। এই ড্রোন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকেও সহায়তা করেছে বলে ধারণা করা হয়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই ড্রোনের সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে ড্রোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হালুক বেরাকতারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ইউক্রেনের জনগণ এই ড্রোন কেনার জন্য প্রকাশ্যে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করেছে।

জার্মানির ইনস্টিটিউ ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ারসের (এসডব্লিউপি) তথ্য মতে, আফ্রিকায় তুরস্কের তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির হার এখন 'আকাশচুম্বী'।

লিথুনিয়ার সিয়াউলিয়াই বিমান ঘাঁটিতে বেরাকতার ড্রোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হালুক বেরাকতার, লিথুনিয়ায় ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত পেত্রো বেশতা ও লিথুনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরভিদাস আনুসাউসকাস। ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় তুরস্কের ভূমিকা

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কবিরোধী আন্দোলন 'আরব বসন্ত'র প্রভাবে কয়েকটি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেখান থেকে শরণার্থীদের ঢেউ তুরস্ক হয়ে এসে পড়ে ইউরোপে।

সশস্ত্র সংগঠনগুলোর হামলার পাশাপাশি সরকারের দমননীতি থেকে বাঁচতে আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে, বিশেষ করে সিরিয়া থেকে সাধারণ মানুষ তুরস্কে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তারা অনায়াসে ঢুকে পড়েন ইউরোপের দেশগুলোয়। ফলে, শরণার্থীদের ঢেউ সামাল দিতে হিমশিম খেতে শুরু করে ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলো।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইউরোপে আরও শরণার্থী পাঠানোর হুমকি দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের আভিজাত্য দূরে ঠেলে তুলনামূলকভাবে গরিব দেশ তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। এ সংকট সমাধানে তারা আঙ্কারাকে অংশীদার মনে করতে শুরু করে।

জার্মানির তুর্কি জনগোষ্ঠী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানিতে শ্রমিক সংকট দেখা দিলে তুরস্ক থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে যোগ দেন। সেই থেকে ইউরোপের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই দেশের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তুর্কি বংশোদ্ভূত।

২০১৮ সালে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনে জার্মানির সেই তুর্কি বংশোদ্ভূত জনগণের ৬০ শতাংশের বেশি এরদোয়ানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, জার্মানির তুর্কিরা তাদের জার্মান নাগরিকত্বের পাশাপাশি তুরস্কের এরদোয়ান সরকারকেও বেশ গুরুত্ব দেন।

বলা বাহুল্য, শুধু জার্মানিই নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তুর্কি বংশোদ্ভূত জনগণ, যারা সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলছেন। এই বাস্তবতা ইউরোপ কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছে না।

সার্বিক বাস্তবতায় তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকলেও সব মিলিয়ে বলা যায় যে, দেশটি দিনে দিনে সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

2h ago