‘বড় বড় বুদ্ধিজীবী যারা অনুগামী হয়ে কাজ করেন, তারাই তো উপাচার্য বা কর্তাব্যক্তি হন’
গত ১৪ জানুয়ারি সিলেট শহরের কাজলশাহ এলাকার একটি বাসা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বলা হয় প্রতীকের আত্মহত্যা করেছেন। দীর্ঘ হতাশা থেকে এ আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করার পাশাপাশি তুলে ধরা হয় তিনটি সম্ভাব্য কারণ। যার মধ্যে রয়েছে পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা রকমের মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন- এমন অভিযোগ অনেকদিন থেকেই জানা যাচ্ছে। এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এবারও একজন মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলেন। পরিবারের অভিযোগ, তাকেও তার বিভাগের শিক্ষকরা মানসিকভাবে নিপীড়ণ করেছেন। এই ঘটনাটি নিয়ে গতকাল থেকে দ্য ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষক রাজনীতি- এসব বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে কথা হয় তিনজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমাদের এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ১১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সম্প্রতি শাহজালালেও এমন ঘটনা ঘটলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহযোগিতামূলক ও সৃজনশীল পরিবেশ নেই। যে পরিবেশ রয়েছে তা এলিনেশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা চলছে কিন্তু মানবিক গুণ তৈরি হচ্ছে না। দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময় মানুষ অন্যের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে না। এখানে পরস্পরের ওপর নির্যাতন চলে। যখন কারো পক্ষে তা অসহ্য হয় তখন সে এই রকম জায়গায় (আত্মহনন) চলে যায়।”
প্রতীকের আত্মহত্যাকে কোনো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় উল্লেখ করে এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বলেন, “এটি একটি বাস্তবতাকে উন্মোচন করে দিচ্ছে।”
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সৃজনশীল পরিবেশ যে নাই এর একটি কারণ হচ্ছে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ২৮ বছরে কোনো ছাত্র সংসদ নেই। এর ফলে এই ছেলে-মেয়েরা সৃজনশীলতার চর্চা করতে পারে না। তাদের যে বিনোদন দরকার বা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে যে জায়গা দরকার তা নেই। সেই পরিবেশ উন্নত না হওয়াটাও একটা কারণ,” যোগ করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এর মতে, “বাংলাদেশে শিক্ষকরা শিক্ষকসুলভ বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিক্ষক হতে পারছেন না বা শিক্ষক থাকতে পারছেন না। বড় বড় বুদ্ধিজীবী যারা অনুগামী হয়ে কাজ করেন তারাই তো উপাচার্য বা কর্তাব্যক্তি হন। তাদের কাছ থেকে কোনো উন্নয়ন আশা করা যায় না। গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।”
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন বা সংস্কার দরকার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “সৃজনশীল, জ্ঞানমুখী, অনুসন্ধিচ্ছামুখী পরীক্ষাপদ্ধতি করা দরকার। কিন্তু, এসব কার উদ্দেশে বলা?- সবইতো অরণ্যে রোদন। সরকার এসব কথা শুনছে না, কিন্তু, কোনো বিরোধীদল কী এসব শুনছে? গোটা জাতির রাজনীতি এখন নষ্ট হয়ে গেছে।”
তার মতে, “এসব একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হচ্ছে। সুবিধাবাদী, ভোগবাদী মোনাফেক স্বভাবের লোকেরা সমাজের উচ্চশ্রেণির লোক। তাদের থেকে সরকার গঠিত হচ্ছে। এরকম পদ্ধতিতে যে সরকার গঠিত হয় সে সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা ভালো হতে পারে না- তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির হোক না কেনো- তা ধীরে ধীরে অধোগতির দিকে যাচ্ছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “অভিযোগ তো আছে যে পরীক্ষার ফলাফলে ম্যানুপুলেশন করা হয়। কোনো কোনো পক্ষপাতমূলক পদক্ষেপের কারণে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ধরণের অভিযোগগুলো বেশ প্রবলভাবে আছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়ে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা কিংবা তাদের যে চেষ্টা সে পথে নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।”
তার মতে, “এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ব্যবস্থাটি শক্তিশালী করা দরকার। কোনো শিক্ষক যদি কোনো রকম অনিয়ম করেন কিংবা চাপ সৃষ্টি করেন কিংবা তাহলে তাদের জবাবদিহিতা করতে হবে। এই ব্যবস্থাটি শক্তিশালী হওয়া দরকার।”
“এখানে শিক্ষার্থীদের একটা ভূমিকা থাকার কথা। যেমন- ছাত্র সংসদ নেই, সেটি একটি সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে তা অনেক বেশি সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখন খুব দুর্বল।”
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতির কারণে এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: মেধাবী শিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যা’, পরিবারের অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে
Comments